ছুটি বিহীন ৩৫ বছর শিক্ষকতা

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল গূণী এই শিক্ষকের এক নজর দেখার, যখন তিনি নিজ গ্রাম কুচলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে পুরস্কার গ্রহণ করেন। আমি শুনে অবাক হয়েছিলাম তিনি চাকুরী জীবনে ছুটির দিন ব্যাতীত আর কোন দিন ছুটি নেননি। তখন থেকে এই গুণি শিক্ষকের এক নজর দেখার জন্য দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম উক্ত অনুষ্ঠানে। যখন তিনি মঞ্চে উপস্থিত হলেন তখন আমার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে উক্ত অনুষ্ঠানে হাজির হওয়া যেন সার্থক হোলো।

এবার গুণী শিক্ষকের মুখের দু’টি কথা শোনার পালা। সত্যজিৎ বিশ্বাস বললেন, ছোটবেলা থেকেই শিক্ষকতা করার খুব ইচ্ছে ছিল। পড়াশোনা শেষ করে যখন চাকরি পাই, তখন নিজেই প্রতিজ্ঞা করি শিক্ষকতা জীবনে কোনোদিন কামাই (ছুটি) করবো না। বিজ্ঞান বিভাগের কোনো শিক্ষক না থাকায় আমার ক্লাসগুলো অন্য কোনো শিক্ষক নিতে পারতেন না। আমি মনে করতাম, আমি যদি স্কুলে আসা বন্ধ করি, তাহলে সেই দিন স্কুলে আসা শিক্ষার্থীদের সেই অধ্যায় অন্যকেউ পড়াতে পারবে না। এই কারণেই শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে আমি কোনো দিন স্কুলে আসা বন্ধ করিনি। সরকারি ছুটি ছাড়া আমি কোনো দিন স্কুলে আসা বন্ধ করিনি। তারপরও ছুটির দিনে শিক্ষার্থীদের না দেখলে আমার সেই দিন ভালো কাটতো না।

বিয়ের দিনের স্মৃতিচারণ করে সত্যজিৎ বলেন, বিয়ের দিন রাতে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন না করে সকালে উঠে স্কুলে গিয়েছিলাম। প্রথমে তো আমার পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিয়ে শেষ না করে যেতে দেবে না। তারপর আমার প্রতিজ্ঞার কথা বলায় সকলেই স্কুলে যেতে দেয়। স্কুল শেষ করে আবার শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে বিয়ের বাকি কাজ সম্পন্ন করি।

১৯৯৩ সালে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান তার বাবা মাধবচন্দ্র বিশ্বাস। তখন পাড়ার লোকজনকে ডেকে তিনি নিজের প্রতিজ্ঞার কথা বলেন। এরপর যোগ দেন ক্লাসে। বিকেলে স্কুল ছুটির পর বাবার সৎকার করেন। একই প্রতিষ্ঠানে পদোন্নতি পেয়ে ২০১৫ সালে সহকারী প্রধান শিক্ষক হন সত্যজিৎ। সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়েও নিয়মিত নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান এবং পদার্থবিজ্ঞান পড়ান। ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনে ঘটে গেছে কত কী। বিয়ে এমনকি বাবার মৃত্যুর দিনেও হাজির ছিলেন স্কুলে। তার শিক্ষাদানের দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর মন।

গুণী এই মানুষটি কর্মক্ষেত্রে তিনি যেমন সফল তেমনি পরিবার প্রধান হিসেবেও। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। ছেলে অভিজিৎ বিশ্বাস কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির অপেক্ষায়। আর মেয়ে প্রিয়াঙ্কা বিশ্বাস পশুপালনের ওপর স্নাতকোত্তর করছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্ত্রী আরতী বিশ্বাস গৃহিণী। সত্যজিৎ বিশ্বাস ১৯৮৪ সালে বিএসসি পাস করেন। এর দু’বছর পর ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৯০ সালে ২৫ এপ্রিল রাতে নড়াইলের পঁচিশা গ্রামের আরতী বিশ্বাসকে বিয়ে করেন সত্যজিৎ। বিয়ের অর্ধেক কাজ সেরে নববধূকে রেখে পরদিন সকালে ২০ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে সময়মতো স্কুলে হাজির হন। বিকেলে ছুটির পর আবার ২০ কি.মি. পাড়ি দিয়ে শ্বশুরবাড়ি গিয়েবিয়ের বাকি কাজ সম্পন্ন করেন।

ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৯০ সাল প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি এখানে যোগ দিই। সেই থেকে সত্যজিৎ বিশ্বাস আমরা সহকর্মী। কোনোদিন দেখিনি ঝড়-বৃষ্টি বা অসুস্থতার কথা বলে তাকে ছুটি নিতে। আমি একদিন স্কুল মিটিংয়ে সত্যজিৎ বিশ্বাসকে প্রশ্ন করি আপনার নিয়মিত স্কুলে আসার কারণটা কী? উত্তরে তিনি বলেন, স্কুলের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তাদের না দেখলে আমার ভালো লাগে না। স্কুল ৯টায় শুরু হলে তিনি স্কুলের চাকরিকালের প্রথম থেকে এখন অবধি সাড়ে ৮টার মধ্যে উপস্থিত হন। স্কুলে নতুন ব্যাচ আসলে তিনি যেমন খুশি হন, তেমনি কোনো ব্যাচ বিদায় নিয়ে চলে গেলে তারমতো অন্য কোনো শিক্ষক কষ্ট পান না।

নজরুল ইসলাম ইসলাম আরও বলেন, শনিবার তিনি শেষদিনের মতো দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে বিদায় দিতে খারাপ লাগছে। কিন্তু এটিই নিয়ম। তারমতো শিক্ষকের অভাব পূরণ হবার নয়। তার অবসরকালীণ জীবনের জন্য শুভ কামনা জানাই।

সত্যজিৎ বিশ্বাস জানান, টানা ৩৫ বছর ধরে তিনি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। এখন বিদায়ের সময় এসেছে। তারপরও স্কুলে আসা যাওয়া করবেন। আর অবসরকালে এলাকার বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের জন্য ভূমিকা রাখবেন। পাশাপাশি এলাকার শিক্ষার্থীদের ভালো ফলাফলে উদ্বুদ্ধ করতে পুরস্কারের ব্যবস্থা করারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানালেন কর্তব্যপরায়ণতার অনন্য নজির স্থাপনকারী এই শিক্ষক। বিরতিহীন’ ৩৫ বছরের শিক্ষকতা জীবনের ইতি টানলেন অনন্য নজির স্থাপনকারী শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস (৬০)। কোনো ধরনের অনুপস্থিতি বা ছুটি ছাড়াই এই ৩৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন তিনি। নিজের বিয়ে বা বাবার শেষকৃত্য-কোনো প্রয়োজনেই ছুটি নেননি তিনি।

জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই শিক্ষক শনিবার (৯ অক্টোবর ২০২১) অবসরে গেছেন। এই গুণী শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক। তিনি যশোরের মণিরাপুর উপজেলার হরিদাস কাটি ইউনিয়নের কুচলিয়া গ্রামের বাসিন্দা। এমন একজন দেশবরেণ্য গুণী ও কর্তব্যপরায়ণ শিক্ষকের অবসরকালীন সময় সুখময় হোক ঈশ্বরের কাছে এই কামনা নিরন্তর।

শ্রদ্ধাবনত
উজ্বল কুমার মজুমদার
কোটচাঁদপুর, ঝিনাইদহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *