হঠাৎ বদলে গেল দৃশ্যপট নানামুখী চাপে বিএনপি

নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনায় হঠাৎ করেই দেশের রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে গেছে। এক বছর ধরে প্রধান দুই দলের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি থাকলেও মোটাদাগে তা ছিল শান্তিপূর্ণ; কিন্তু গত শনিবারের সংঘর্ষ, বিভিন্ন স্থাপনা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং হতাহতের মধ্য দিয়ে সংঘাতময় হয়ে উঠেছে পরিস্থিতি। আন্দোলনকারীদের হামলায় পুলিশের মৃত্যুর পর কঠোর অবস্থানে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই ঘটনার জেরে গ্রেপ্তার হয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছেন দলের শীর্ষ নেতার প্রায় সবাই। এতে চলমান আন্দোলনে দৃশ্যমান নেতৃত্ব সংকটের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। আন্দোলনের কৌশল বদলে বিএনপিকে হরতাল-অবরোধের পথে যেতে হয়েছে। তবে

 

 

পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কর্মসূচি কার্যকরভাবে কতদিন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব—তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এর মধ্যে আবার সহিংসতা পর্যালোচনা করে ভিসা নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সার্বিক এই পরিস্থিতি জাতীয় নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার আগ মুহূর্তে বিএনপিকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দীর্ঘ প্রায় দেড় যুগ ধরে ক্ষমতার বাইরে আছে বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে জোরদার আন্দোলনের পরও ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছিল দলটি। এরপর ২০১৫ সালে আরেক দফা চেষ্টা করেও সরকার পতন আন্দোলনে সফল হয়নি। বরং জ্বালাও-পোড়াওয়ের কারণে দেশ-বিদেশে বিএনপির নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হয়। সেইসঙ্গে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী মামলা ও গ্রেপ্তারের শিকার হওয়ায় দলের

 

 

সাংগঠনিক অবস্থা নাজুক হয়ে পড়ে। সেই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আন্দোলনের মধ্যে থেকেই শেষ মুহূর্তে ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। তবে ফলাফল তাদের অনুকূলে আসেনি। আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভরে রাখাসহ ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে ওই নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। ওই নির্বাচনের পর থেকেই দল গোছানোসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেও নির্দলীয় সরকার ছাড়া তাতে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় অবস্থান বজায় রেখেছে দলটি।সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে টানা আন্দোলনে আছে বিএনপি। এরই মধ্যে বিভিন্ন দল ও জোট তাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে। এ বছরের ১২ জুলাই থেকে একদফা দাবিতে তাদের কর্মসূচি চলছে।

 

 

বিভিন্ন সময়ে পদযাত্রা, সমাবেশ, অনশন, বিক্ষোভ ও মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করে দলটি। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরুর ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। পুলিশের অনুমিত ছাড়াই সেদিন ঢাকায় সমাবেশ করে বিএনপির পুরোনো মিত্র জামায়াতে ইসলামী।অন্যদিকে ‘শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ’ কর্মসূচি দিয়ে ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাজপথে ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও। বড় দুটি দলের এমন পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছি। যদিও দুদলই তাদের কর্মসূচি ‘শান্তিপূর্ণ’ হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছিল।কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর পরিস্থিতি শান্ত থাকেনি। মহাসমাবেশকে ঘিরে নয়াপল্টনের আশপাশের এলাকায় বিএনপি কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা হয়েছে।

 

 

পুলিশ হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া হয়েছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বেশ কিছু গাড়ি। এই সহিংসতায় একজন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। নিহত হয়েছেন যুবদলের একজন নেতাও। সাংবাদিকদের ওপর হামলা হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ের আগেই মহাসমাবেশ শেষ করতে বাধ্য হয় বিনপি।বিএনপির দাবি, অতীতের মতো সেদিনও নেতাকর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হতো। একদফা আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে সংঘাত সৃষ্টি করেছে।তারা মনে করেন, দলীয় নেতাকর্মীদের কেউ কেউ হয়তো না বুঝে সরকারের ফাঁদে পা দিয়েছিল, তবে তাদের সংখ্যা ছিল নগণ্য। তাছাড়া যে কোনো পরিস্থিতিতে শান্ত থাকার বার্তা বিএনপির

 

 

হাইকমান্ড মাঠপর্যায়ের কর্মীদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনও হতে পারে, বারবার ঢাকায় এসে ফিরে যেতে হওয়ায় কর্মীরা ক্ষুব্ধ ছিল। মাঠ দখল করে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনের দিকে যাওয়াই তাদের মনোভাব ছিল। সে কারণে নেতাকর্মীদের একটি অংশ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখী ভূমিকার কারণেই পরিস্থিতি রক্তপাতের পর্যায়ে গেছে বলে মনে করে বিএনপি। দলটির দাবি, ক্ষমতা হারানোর ভয়ে সরকার সম্পূর্ণ মাস্টারপ্ল্যান করে বিএনপির সমাবেশে হামলা করিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের একাংশের হঠকারিতায় শুধু মহাসমাবেশই পণ্ড হয়নি, বিএনপির একদফার আন্দোলনকেই চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সহিংসতার জেরে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী,

 

 

যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, তরুণ নেতা ইশরাক হোসেনসহ অনেকের বাসায় হামলা চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেপ্তার এড়াতে শীর্ষ নেতাদের প্রায় সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে অজ্ঞাত স্থান থেকে। ফলে রাজপথে কার নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হবে—সে প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে।জানা গেছে, মহাসমাবেশের পর আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো দপ্তর ঘেরাওয়ের চিন্তা ছিল বিএনপির। আপাতত বড় জমায়েতকেন্দ্রিক কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির পরিকল্পনা ছিল তাদের। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচিতে যেতে হয়েছে তাদের। রোববার হরতাল কর্মসূচি পালনের পর আজ মঙ্গলবার থেকে সারা দেশে ৭২ ঘণ্টা রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ

 

 

অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি। তবে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, শীর্ষ নেতাদের আত্মগোপন, পুলিশের কঠোর মনোভাব এবং রাজপথে ক্ষমতাসীন দলের সক্রিয় অবস্থানের ফলে বিএনপি ও তাদের মিত্রদের এ ধরনের কর্মসূচি কতটা কার্যকর হবে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।বিশ্লেষকদের মতে, পাল্টাপাল্টি অবস্থানে থাকলেও নির্দিষ্ট স্থানে সভা-সমাবেশ করা হলে তাতে সংঘাতের আশঙ্কা কম থাকে। কিন্তু অবরোধের মতো কর্মসূচিতে সংঘাতের মাত্রা আরও বাড়তে পারে। এ অবস্থায় সহিংসতা এড়িয়ে একদফার আন্দোলনকে যৌক্তিক পরিণতিতে পৌঁছানো বিএনপির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।এদিকে বিএনপি সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে মহাসমাবেশ শেষ করতে না পারলেও দলটির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত কৌশলে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। পুলিশের অনুমতি না পেলেও

 

 

কমলাপুর-আরামবাগ এলাকায় সমাবেশ করেছে দলটি। এ ঘটনায় অনেকে মনে করছেন, দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকা জামায়াত পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কর্মসূচি করতে পারলেও বিএনপি সহিংসতায় জড়িয়েছে, যা দলটিকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিয়েছে। এ ঘটনায় দেশি-বিদেশি ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছে বিএনপি। এই চাপ কাটিয়ে তাদের পক্ষে সরকারকে পাল্টা চাপে ফেলে আন্দোলন সফল করা কঠিন হবে।শধু দেশে নয়, সহিংসতার ঘটনায় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও চাপে পড়েছে বিএনপি। ইতোমধ্যেই সহিংসতার ঘটনা পর্যালোচনা করে ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘সম্ভাব্য ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে আমরা সব সহিংসতার ঘটনাকে পর্যালোচনা করব।’এর সঙ্গে যুক্ত

 

 

হয়েছে বিএনপি অফিসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে মিয়া আরেফির সংবাদ সম্মেলন করার ঘটনা। পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে এই ব্যক্তি কীভাবে দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে বক্তৃতা দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ঘটনা বিএনপি নেতাদের দায়িত্বশীলতা এবং তাদের কূটনৈতিক তৎপরতার বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বেও তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী দৈনিক কালবেলাকে বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগ করবে, পুরো ঘটনা গভীরভাবে পর্যালোচনা করেই হয়তো তারা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। সুতরাং চাপে কে পড়বে, মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা কাদের ওপর আরোপ হবে, সেটা পরবর্তী পর্যায়ের কর্মকাণ্ডের মধ্য

 

 

দিয়ে নির্ধারিত হবে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, এসব ঘটনার দায় বিএনপির ওপর বর্তাতে পারে। তবে চতুর্দিক থেকে যেসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন দলের ওপর আরও স্যাংশন আসতে পারে।’ এদিকে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চের দাবি, একদফার আন্দোলন দমাতে বিরোধী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ-সমাবেশে সরকারের মদদে পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হয়েছে। তবে এতে সরকারের শেষ রক্ষা হবে নাএ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘একদফার চলমান আন্দোলন দমাতে বিরোধী দলগুলোর মহাসমাবেশ পণ্ড করে সেটিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। যেটা আমরা আগেই আশঙ্কা

 

 

করেছিলাম, এটা এখন সত্য প্রমাণিত হলো।’তিনি বলেন, ‘এটিকে অজুহাত হিসেবে ধরে এখন বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা, পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে মানুষ এগুলো ধরে ফেলেছে। সরকার যত দমন-পীড়ন চালাবে, জনগণ থেকে তারা তত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। দমন-পীড়ন করে এবার সরকার শেষ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ, মানুষ এবার মরিয়া। তারা ব্যাপকভাবে হরতাল সফল করার মধ্য দিয়ে সরকারের প্রতি তাদের

 

 

চূড়ান্ত অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে মানুষ আরও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করবে।’গণতন্ত্র মঞ্চের এই নেতা বলেন, ‘২০১৪ ও ২০১৮ আর আর ২০২৩-২৪ এক নয়। বিষয়টা হয়তো এখনো সরকারের উপলব্ধির মধ্যে নেই। জনসম্পৃক্ত আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আগামী কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো তারা আরওভালো করে এটি উপলব্ধি করতে পারবেন।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *