শেষ সময়েও স্ত্রীকে আশ্বস্ত করা মিনারুল কথা রাখতে পারলেন না

আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে না। ভালো হয়ে যাব। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে না,’ শরীরের ৯৫ শতাংশ পোড়া নিয়ে লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আগে এভাবেই স্ত্রীকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছিলেন মিনারুল ইসলাম। কিন্তু ৩৫ বছরের এই যুবককে বাঁচানো যায়নি। ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে মঙ্গলবার রাতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয় মিনারুলকে। আজ বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁর মৃত্যু হয়।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা মিনারুলের মৃত্যুতে অনিশ্চয়তার ছায়ায় ঢাকা পড়েছে সদ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা স্ত্রী সুরাইয়া খাতুনের ভবিষ্যৎ। স্বামীর মৃত্যুর পর আজ দুপুরে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মাত্র পড়া শেষ হলো। মেয়ে মুনতাহারের বয়স মাত্র ৯ মাস ১৮ দিন। কী থেকে কী হইলো, আমি আসলে কিছুই বুঝতে পারছি না।’

সুরাইয়া খাতুন এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ১০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে। স্ত্রীর বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে মুনতাহারকে কোলে নিয়ে ছবি তুলেছেন মিনারুল। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন তিনি। লিখেছিলেন, ‘মামণির আম্মুর প্রিয় ইতিহাস বিভাগ’। এর এক দিন পরই মেয়ে মুনতাহারকে নিয়ে মেট্রারেলে উঠেছিলেন মিনারুল। সেই ছবিও পোস্ট করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে দেখা যায় বাবা, মেয়ে আর বাইরে অনেক সবুজ। দুই দিন পরই ঘটে তাঁদের বাসায় গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা। যাতে দগ্ধ হয়ে এর আগেই মিনারুলের বাবা মো. ফরমান মণ্ডল (৭৫) মারা গেছেন।

১৩ আগস্ট রোববার রাতে গাজীপুর মহানগরীর বোর্ডবাজার (মুক্তারবাড়ি) এলাকায় মিনারুলদের বাসায় জমে থাকা গ্যাসের বিস্ফোরণ ঘটে। মিনারুল ও তাঁর বাবা ছাড়াও মিনারুলের মা খাদিজা বেগম (৬৫) এবং গ্যাসের সমস্যা ঠিক করতে আসা শফিকুল ইসলাম গুরুতর দগ্ধ হন।

তাঁদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সোমবার বিকেলে মারা যান ৯৫ শতাংশ দগ্ধ ফরমান মণ্ডল। বৃহস্পতিবার সকালে মারা গেলেন ছেলে মো. মিনারুল ইসলাম। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক চিকিৎসক হোসাইন ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, মঙ্গলবার দুপুরে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছিল মিনারুল ইসলামকে। তাঁর মানসিক জোর ছিল অনেক। সেদিন রাতেই তাঁকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। বুধবার বিকেল থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টায় মারা যান তিনি।

বর্তমানে মিনারুলের মা খাদিজা বেগমের চিকিৎসা চলছে জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, তাঁর শরীরের ৪০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। তবে তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। আগে থেকেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে। সে কারণে তাঁর শারীরিক অবস্থাও শঙ্কামুক্ত নয়।

আজ মিনারুলের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী ছাড়াও ভাই আবুল হাসানের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, মঙ্গলবার রাতে মিনারুলকে যখন লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়, তখন তার সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে সময় মাত্রই গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে বাবাকে দাফন করে অগ্নিদগ্ধ ভাইয়ের কাছে ছুটে এসেছিলেন তিনি। ‘ও আমাকে বলেছিল, আমি খুব ভালো আছি। কোনো কষ্ট নাই,’ এটাই ভাইয়ের শেষ কথা ছিল বলে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন ভাই হারানো আবুল হাসান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করতেন মিনারুল। পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলায় বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। দুর্ঘটনার দুই দিন আগে মিনারুল ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতা অনুযায়ী নিজস্ব পরিচয় তৈরি হয়। নিজে সংগ্রাম করে, নিজেকে তৈরি করা যে কত গর্বের, কত আনন্দের তা কখনো বংশপরম্পরায় পাওয়া ব্যক্তিরা অনুভব করতে পারে না।’

আজ বেলা আড়াইটায় যখন মিনারুলের ভাই আর স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়, তখন তাঁরা অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অ্যাম্বুলেন্স এলে মিনারুলের মরদেহ নিয়ে যাবেন গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে। সেখানে বাবার কবরের পাশে দাফন করা হবে মিনারুল ইসলামকে।

বিকেল সাড়ে চারটায় আবার কথা হয় আবুল হাসানের সঙ্গে। মিনারুলের মরদেহ নিয়ে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্স তখন রাজধানীর ধানমন্ডি অতিক্রম করছে। আশপাশের শব্দের ভেতর শোনা গেল এক শিশুর কান্না। হতে পারে তা মিনারুল ইসলামের একমাত্র মেয়ে মুনতাহারের। স্ত্রী সুরাইয়া খাতুন দুপুরে স্বামীর মরদেহর সামনে অপেক্ষা করতে করতে বলেছিলেন, মেয়েটা এখনো কিছুই বুঝতে শেখেনি। কিন্তু বাবাকে খুঁজছে চোখে চোখে।

আর আবুল হাসান বললেন, ‘আমাদের পরিবারে এই একটা ভাই-ই সরকারি চাকরি করত। যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত, তখন আমরা বাড়ি থেকে তার মাসের খরচ পাঠাতাম। কোনো দিন টিউশনি করতে দেই নাই। আমার ভাইটা মেধাবী ছিল। অনেক আদরে বড় করছি আমরা। এখন সেই ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফিরছি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *