মসজিদুল আকসা পুনরুদ্ধার করেছিলেন যে মুসলিম বীর

ইতিহাসখ্যাত মুসলিম বিজেতাদের অন্যতম সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী রহ.। ক্রসেডার ও ‘নাইট টেম্পলারদের হাত থেকে ‘পবিত্র ভূমি বায়তুল মুকাদ্দাস পু’নরুদ্ধারে অসীম সাহসিকতা, দক্ষ সমরকুশল ইতিহাসে তাকে দিয়েছে এক অনন্য পরিচিতি। ‘আল আকসা বিজেতা বীর হিসেবেই তার নাম জ্বলজ্বল করছে ইতিহাসে। ‘আল আকসা বিজয়ের পেছনের রয়েছে সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর চমকপ্রদ যুদ্ধরীতি ও মহানুভবতার ইতিহাস।

 

খ্রিস্টানদের মসজিদুল আকসা দখল

খ্রিস্টিয় একাদশ, দ্বাদশ শতাব্দী ছিল ‘মুসলমানদের ঘন-দুর্যোগের সময়। আব্বাসী খেলাফতাধীন সীমান্তবর্তী আনাতোলিয়া অঞ্চলে সেলজুক ‘সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ইসলামি বিশ্বের রক্ষণভাগ দুর্বল হয়ে পড়ে। ‘খ্রিস্টানরা এটিকে জেরুসালেম দখলের মোক্ষম সুযোগ মনে করে।

এ সময় রোমান ক্যাথলিক চার্চের প্রধান, ফরাসী অভিজাত পরিবারের পোপ দ্বিতীয় আরবান ইউরোপের রাজন্যবর্গকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে ‘ধর্মযুদ্ধের ডাক দেয়। যেটি ক্রুসেড নামে পরিচিতি ‘লাভ করে। ‘সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করে নিজেদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার এবং বায়তুল মুকাদ্দাস দখল ছিল ‘এই ক্রুসেডের মুখ্য উদ্দেশ্য।

মুসলিম জাহানের দুর্বলতার সুযোগে ইউরোপের ‘ধর্মোন্মাদ ক্রুসেডার এবং নাইট ট্যাম্পলার বাহিনী যৌথ অভিযানের মাধ্যমে দামেস্ক, আলেপ্পো, ‘হিমসের মতো গুরুত্বপূর্ণ শহর একের পর এক জয় করতে থাকে। ‘এমনকি গোটা সিরিয়াজুড়েই তারা আধিপত্য কায়েম করে।

অবশেষে ৪৯২ হিজরী মোতাবেক ১০৯৯ ‘সালের মাঝামাঝি সময়ে কোনো প্রকার ‘প্রতিরোধ ছাড়াই বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয় সম্মিলিত খ্রিস্টান বাহিনী। ‘কয়েক দিন ধরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দখলদার বাহিনী।

ইনসাইক্লোপিডিয়া বৃটেনিকার বর্ণনামতে, ‘ধর্মযোদ্ধারা বায়তুল মুকাদ্দাস’ বিজয়ের সময় এমন ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল যে, বলা হয়, ‘মসজিদে ওমরে যাওয়ার পথে তাদের ঘোড়া হাঁটু পর্যন্ত রক্তে ডুবে গিয়েছিল। ‘দেয়ালে দেয়ালে আছড়ে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। ‘অথবা নগর-প্রাচীর থেকে চরকির মতো ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।’

দখলদার বাহিনী এ সময় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন শুরু করে। হারাম শরিফের ‘মসজিদগুলোকে তারা গীর্জায় রূপান্তর করে। ইহুদিদেরকে শহর ‘থেকে বের করে দেয়। অ-খ্রিস্টান লোকদেরকে ধর্মান্তকরণে ‘বাধ্য করে।

ক্রুসেডারদের প্রতিরোধে জিনকি :সাম্রাজ্যের ভূমিকা

ইসলামের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কোনো অঞ্চলে প্রতাপশালী মুসলিম কোনো সাম্রাজ্যের পতন হলে অন্য কোনো সালতানাত তার স্থলাভিষিক্ত হয়। ক্রুসেড ঝড়ের সময়ও জিনকি সালতানাত সেলজুক সাম্রাজ্যের স্থলাভিষিক্ত হয়ে মুসলিম ভূমির রক্ষাকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়।

জিনকি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ইমাদুদ্দীন জিংকির প্রতিরোধের মুখে ক্রুশেডারদের বিজয়রথ অবশেষে থামে। বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করে বহু রণক্ষেত্রে ক্রুসেড বাহিনীকে পর্যদুস্ত করেন ইমাদুদ্দীন। বেশ কিছু শহর তিনি পুনঃদখল করেন।

ইমাদুদ্দীন জিংকির মৃত্যুর পর তার স্থলাভিষিক্ত সুলতান নুরুদ্দীন জিংকি পিতার ক্রুসেড প্রতিরোধের মিশনে আরও গতি সঞ্চার করেন। যে দুর্বার গতিতে ক্রুসেড বাহিনী শহরের পর শহর দখল করেছিল তার দ্বিগুণ গতিতে সুলতান নুরুদ্দীন জিংকি সেসব শহর ফিরিয়ে নিতে থাকেন। বায়তুল মুকাদ্দাস ছাড়া ফিলিস্তিনের প্রায় সমগ্র ভূখণ্ড থেকে তিনি ক্রুসেড বাহিনীকে বিতাড়িত করতে সমর্থ হন।

 

সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর ক্ষমতা গ্রহণ

মসজিদুল আকসা বিজয়ের আগেই আল মালিকুল আদিল (ন্যায়পরায়ন শাসক) উপাধী খ্যাত সুলতান নুরুদ্দীন জিংকির ওফাত হয়। এরপর তার স্থলাভিষিক্ত হন তারই প্রিয়পাত্র এবং মনোনীত ব্যক্তি সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী।

ইরাকের মসুলে জন্ম নেওয়া সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবীর দাদা এবং পিতা সেলজুক শাসনাধীন তিরকিত দুর্গের প্রধান ছিলেন। তারা ছিলেন কুর্দি বংশদ্ভোত। কিন্তু মুজাহিদ বাহরুয নামের এক সেলজুক আমীরের বিরাগভাজন হয়ে সালাহুদ্দীনের পিতা নাজমুদ্দীন এবং তার ভাই শিরকাও জিনকি সুলতান ইমাদুদ্দীনের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এখানেই সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী সুলতান নুরুদ্দীন জিংকির সান্নিধ্যে আসেন। অনেক বিজয়াভিযানে তার সঙ্গে নেতৃত্ব দেন এবং সুলতান জিংকির মৃত্যুর পরে তার স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত হন।

হিত্তীনের যুদ্ধে ক্রুসেড বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় 

ইসলামের ইতিহাসে যে কয়েকটি যুদ্ধকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, ১১৮৭ সালের হিত্তীন যুদ্ধ তার অন্যতম। প্রায় ৩০ হাজার খ্রিস্টান সৈন্যের খণ্ডিত লাশ পড়ে ছিল হিত্তীনের ময়দানে। এ যুদ্ধে পরাজযের মাধ্যমে খ্রিস্টান সম্মিলিত শক্তির কোমড় ভেঙ্গে যায় এবং চূড়ান্ত পরাজয়ের মাধ্যমে প্রায় দুশত বছর ধরে চলা প্রথম ক্রুসেডের সমাপ্তির সূচনা ঘটে।

মসজিদুল আকসা পুনরুদ্ধার

হিত্তীন বিজয়ের পরে কার্যত আর কোনো বাধা ছিল না মসজিদুল আকসা পুনরুদ্ধারে। অবশেষে ১১৮৭ খিস্টাব্দের ১২ অক্টোবর মোতাবেক ২৭ রজব ৫৮৩ হিজরীতে বিজয়ী বীর সুলতান গাজী সালাহুদ্দীন আইয়ূবী মসজিদুল আকসায় প্রবেশ করেন। দীর্ঘ নব্বই বছর পর ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমি মসজিদুল আকসায় তাকবীর ধ্বনি উচ্চারিত হলো। কুব্বাতুস সাখরায় স্থাপন করা ক্রুশ চিহ্ন ভূপাতিত করা হলো। গির্জায় রূপান্তর করা মসজিদগুলোতে পুনরায় নামাজ আদায় করা হলো।

সুলতান সালাহুদ্দীনের মহানুভবতা

খ্রিস্টান বাহিনী জেরুসালেম দখলের পরে সেখানে রক্তবন্যা বইয়ে দিয়েছিল। পক্ষান্তরে মহানুভব সুলতান সালাহুদ্দীন আইয়ূবী ঘোষণা করলেন সাধারণ ক্ষমা। সামান্য মুক্তিপণের বিনিময়ে যুদ্ধবন্দি নারী-পুরুষ-শিশুদের তিনি মুক্ত করে দিলেন। এমনকি অপারগদের জন্য তিনি নিজের পক্ষ থেকে মুক্তিপণের ব্যবস্থা করে দিলেন। জিযয়া (কর) প্রদানের শর্তে সাধারণ খ্রিস্টান নাগরিকদের জেরুসালেমে বসবাসের অনুমতি প্রদান করলেন।

প্রত্যেক মুসলমানের প্রাণপ্রিয় সুলতান গাজী সালাহুদ্দীন ইউসুফ বিন আইয়ূব রহ. তার উদারতা এবং মহানভবতার কল্যাণে ‘জাতশত্রু’ ইউরোপীয়দের কাছেও দ্যা গ্রেট সালাদীন নামে পরিচিত।

সূত্র: আত তারিখ ফিল কামিল, মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো, এনসাইক্লোপিডিয়া বৃটেনিকা, আল জাজিরা, উইকিপিডিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *