ভূমিকম্পের ভয়ংকর তথ্য হাদিসে

ভূমিকম্পের আশঙ্কার কথা শুনলেই আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। বর্তমান বিশ্বে ভূমিকম্পের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি মরক্কোর ভূমিকম্পে ইতোমধ্যে ২ হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ৬ দশমিক ৮ মাত্রার এ ভূমিকম্পে মাত্র ২০ সেকেন্ডেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় কয়েকটি শহর। অনেকে ঘুমের মধ্যেই প্রাণ হারান। কোরআন-হাদিসে ভূমিকম্প সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য রয়েছে, যা সকলের জেনে নেওয়া উচিত।

ভূমিকম্পের কারণ
ইসলামি বিশ্বাসমতে, ভূমিকম্প মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক সতর্কবার্তা। মহান আল্লাহ বলেন, (আসলে) আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে আজাবের) নিদর্শনসমূহ পাঠাই। (সুরা ইসরা: ৫৯)

ভূমিকম্পের বিভীষিকা কত মারাত্মক হবে কোরআনের এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা তুলে ধরে এভাবে— ‘হে মানব সকল, তোমরা ভয় করো তোমাদের রবকে। নিশ্চয়ই কেয়ামত দিবসের ভূকম্পন হবে এক মারাত্মক ব্যাপার। যেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে, স্তন্যপায়ী মা তার দুগ্ধপোষ্য সন্তানের কথা ভুলে যাবে আর সব গর্ভবতীর গর্ভপাত হয়ে যাবে। দৃশ্যত মানুষকে মাতালের মতো দেখাবে, আসলে তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ।’ (সুরা হজ: ১-২)

কেয়ামতের অন্যতম আলামত ভূমিকম্প। কেয়ামত যতই নিকটবর্তী হবে ভূমিকম্পের পরিমাণও ততই বাড়তে থাকবে। হাদিসে এসেছে, অশ্লীলতা, মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও বাদ্যযন্ত্রের ব্যাপকতাই এর মূল কারণ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ‘এ উম্মত ভূমিকম্প, বিকৃতি এবং পাথরবর্ষণের মুখোমুখি হবে। একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, কখন সেটা হবে হে আল্লাহ রাসুল? তিনি বলেন, যখন গায়িকা এবং বাদ্যযন্ত্রের প্রকাশ ঘটবে এবং মদপানের সয়লাব হবে। (তিরমিজি: ২২১২)

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত হবে না, যে পর্যন্ত না ইলম উঠিয়ে নেওয়া হবে, অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে, সময় সংকুচিত হয়ে আসবে, ফেতনা প্রকাশ পাবে, খুন-খারাবি বৃদ্ধি পাবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ এত বৃদ্ধি পাবে যে তা উপচে পড়বে। (বুখারি: ১০৩৬)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, ইবনু হাওয়ালা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমার মাথা বা মাথার তালুতে হাত রেখে বলেন, হে ইবনে হাওয়ালা, যখন তুমি দেখবে যে বায়তুল মাকদিসে (সিরিয়ার) ভূমিতে খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তখন মনে করবে অধিক ভূমিকম্প, বিপদ-আপদ, মহা দুর্ঘটনা ও পেরেশানি সন্নিকটে। কেয়ামত তখন মানুষের এতই নিকটবর্তী হবে, যেমন আমার এ হাত তোমার মাথার যত কাছে আছে। (আবু দাউদ: ২৫৩৫)

মানুষ যখন আল্লাহর আদেশ নিষেধ ভুলে গুনাহে বিভোর থাকবে তখন ভূমিকম্পের মাধ্যমে ভূমি তলিয়ে দেওয়া হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে হাদিসে। নবীজি (স.) বলেছেন, ‘যখন অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জিত হবে, কাউকে বিশ্বাস করে সম্পদ গচ্ছিত রাখা হবে কিন্তু তার খেয়ানত করা হবে, জাকাতকে দেখা হবে জরিমানা হিসেবে, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া বিদ্যা অর্জন করা হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু মায়ের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করবে, বন্ধুকে কাছে টেনে নিয়ে পিতাকে দূরে সরিয়ে দেবে, মসজিদে উচ্চৈঃস্বরে শোরগোল হবে, জাতির সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিটি সমাজের শাসকরূপে আবির্ভূত হবে, সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি হবে নেতা, একজন মানুষ যে খারাপ কাজ করে খ্যাতি অর্জন করবে, তাকে তার খারাপ কাজের ভয়ে সম্মান প্রদর্শন করা হবে, বাদ্যযন্ত্র এবং নারী শিল্পীর ব্যাপক প্রচলন হবে, মদ পান করা হবে, লোকজন তাদের পূর্ববর্তী মানুষগুলোকে অভিশাপ দেবে, এমন সময় তীব্র বাতাস প্রবাহিত হবে এবং এমন একটি ভূমিকম্প হবে যা সেই ভূমিকে তলিয়ে দেবে। (তিরমিজি: ১৪৪৭)

কেয়ামতের আগে আজাব সম্পর্কে আল্লাহ তাআলার ঘোষণা—‘জনপদের অধিবাসীরা কি এতই নির্ভয় হয়ে গেছে যে আমার আজাব (নিঝুম) রাতে তাদের কাছে আসবে না, যখন তারা (গভীর) ঘুমে (বিভোর হয়ে) থাকবে!’ (সুরা আরাফ: ৯৭)

ভূমিকম্প থেকে বাঁচার আমল
দান-সদকা: প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে মুক্তির জন্য দরিদ্র ও মিসকিনদের দান করতে উৎসাহ দেয় ইসলাম। রাসুল (স.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (বুখারি: ১৭৩২) ইতিহাসে আছে, ভূমিকম্প হলে উমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) তার গভর্নরদের দান-সদকা করার প্রতি জোর দিতে চিঠি লিখতেন। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, ‘সদকা আল্লাহর অসন্তুষ্টিকে নিভিয়ে দেয় এবং অপমৃত্যু রোধ করে।’ (তিরমিজি: ৬০০)

ইস্তেগফার ও তাওবা: যেকোনো বিপদ-মসিবতে ইস্তেগফার ও তওবা করা মুত্তাকিদের একটি বিশেষ আমল। সেজন্য ভূমিকম্পের সময় প্রত্যেক মুসলমানের আন্তরিকভাবে আল্লাহর কাছে তাওবা করা উচিত। এক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (স.) নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘দ্রুততার সঙ্গে মহান আল্লাহর জিকির করো, তাঁর কাছে তওবা করো।’ (বুখারি: ২/৩০; মুসলিম: ২/৬২৮)

সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ: ভূমিকম্পসহ যেকোনো বিপদ থেকে রক্ষা পেতে নেতৃস্থানীয়দের করণীয় হলো— অধীনদের সত্য ও সঠিক পথে চলতে আদেশ দেওয়া, নিজ নেতৃত্বাধীন এলাকায় আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করা এবং লোকদের সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা। রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি—তোমরা অবশ্যই ভালো কাজে মানুষকে আদেশ দেবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো তাহলে আল্লাহ তোমাদের উপর তাঁর পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তাঁর নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না।’ (তিরমিজি: ৪/৪০৬, নম্বর: ২১৬৯, ভা-২/৪০)

নামাজ ও সবর: সাহাবিদের জীবনেতে আমরা দেখি, বিপদে-মসিবতে তাঁরা নামাজে দাঁড়াতেন ও ধৈর্য ধারণ করতেন। (মেশকাতুল মাসাবিহ: ৫৩৪৫)

তাকওয়া: আল্লাহর গজব ও যেকোনো মসিবত থেকে বেঁচে থাকার বড় উপায় হচ্ছে তাকওয়া অবলম্বন করা। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যদি জনপদের মানুষগুলো ঈমান আনত এবং (আল্লাহকে) ভয় করতো, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান-জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা (আমার নবীকেই) মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। সুতরাং তাদের কৃতকর্মের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করলাম।’ (সুরা আরাফ: ৯৬)

দোয়া: ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক যেকোনো দুর্যোগ, বিপদ-মসিবতে দোয়া পাঠের শিক্ষা রয়েছে হাদিসে। যে কোনো দোয়া করা যায়, তবে বিপদ-মসিবতে বিশেষভাবে যে দোয়াটি পড়ার কথা পাওয়া যায় তা হলো— لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ-লিমিন।’ অর্থ: ‘তুমি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, তুমি পবিত্র সুমহান। আমি নিশ্চয়ই জালিমদের দলভুক্ত।’ (আহমদ, তিরমিজি, মেশকাত: ২২৯২)

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে সময় থাকতে সতর্ক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আল্লাহর পথে ফেরার তাওফিক দান করুন। মাদকদ্রব্যগ্রহণ, বেহায়াপনা ও বাদ্যযন্ত্রের ফেতনা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। ভূমিকম্পের মতো ভয়াবহ দুর্যোগ থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *