বিনা বেতনে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন মোসলেম উদ্দিন

তিস্তার চরে বিনা বেতনে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন মোসলেম উদ্দিন। কোনো দিন স্কুল কামাই দেননি। সবার আগে স্কুলে যান, বের হন সবার পরে। এই আলোর দিশারির গল্প বলছেন রায়হান রাশেদ
বিনা বেতনে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছেন মোসলেম উদ্দিন
নদী ও জীবন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মোসলেম উদ্দিন।

বাড়ি তাঁর লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের ভোটমারী ইউনিয়নের শৌলমারী গ্রামে। বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই। ১৯৬৯ সালে কালীগঞ্জের হাজরানিয়া দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক (এসএসসি) পাস করেন। অভাবের কারণে নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি।

মানুষের জমিতে কাজ করে টাকা-পয়সা জমিয়ে পড়তেন।
মোসলেম উদ্দিনের দুই ছেলে ও চার মেয়ে। চরে সে সময় উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। তা ছাড়া অভাব তো পিছু ছাড়েনি।

ফলে সন্তানদেরও বেশিদূর পড়াতে পারেননি। ‘মুই (আমি) যখন স্কুলে যাং (যাই), তখন শৌলমারী চরৎ আর কোনো স্কুল আছিল নাহ। বালুর মধ্য দিয়ে হাঁটি ছয় কিলোমিটার দূরে যায়া উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ি আসছিনুং। সংসারে অভাবও আছিল সেই সময়।
লেখাপড়া ওই পর্যন্ত।’ রংপুরের আঞ্চলিক ভাষায় বললেন মোসলেম।
স্কুলের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন

তিস্তার এই দুর্গম চরে মাধ্যমিক বিদ্যালয় না থাকায় প্রাথমিকের পর বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে ঝরে পড়ত। মোসলেম মাঠে কাজ করতেন আর সন্ধ্যায় শিশু-কিশোরদের অক্ষরজ্ঞান শেখাতেন। পাড়ার ঘরে ঘরে খোঁজ নিতেন।

কিশোরদের দেখলেই পড়তে যেতে বলতেন। কাউকে কাউকে কানমলা দিয়ে বলতেন, ‘কাল থেকে স্কুলে যাবি। পড়তি আসবি।’ তবে গ্রামে উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় প্রাইমারির পর ছেলেমেয়েদের তেমন জোর দেওয়া যেত না। মোসলেম স্বপ্ন দেখতেন, গ্রামে একটি উচ্চ বিদ্যালয় হবে। ছেলেমেয়েরা আর ঝরে পড়বে না। কিন্তু তাঁর নিজের তো স্কুল করার মতো সামর্থ্য নেই।

গ্রামবাসীকে ডেকে স্কুলের কথা বলতেন। এক সময় এলাকাবাসীও বুঝল স্কুলের গুরুত্ব। সবার আগ্রহে উবা নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামে স্কুল করার উদ্যোগ নেয়। সহযোগিতার হাত বাড়ান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। স্কুলের নাম ‘নদী ও জীবন নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়’।

মোসলেম সেই স্কুলের জন্য দিনরাত খেটেছেন। পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে ধান, ভুট্টা সংগ্রহ করতেন। সেগুলো বেচে মিস্ত্রিদের মজুরি দিতেন। মিস্ত্রিদের সঙ্গে গায়েগতরেও খাটতেন। স্কুলঘর নির্মাণের পর ঘরে ঘরে গিয়ে শিক্ষার্থী নিয়ে আসতেন। বললেন, ‘আমার তো টেকা নেই, গতর দিয়া খাটছি। স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় মুই মানুষের বাড়িত গিয়া ধান, ভুট্টা কালেকশন করি আনছং। তারপর সেগুলে বেচিয়া মিস্ত্রিক টাকা দিছি। মিস্ত্রির সাথে কাজ করি স্কুলটাকে সাজাইছি। মানুষের বাড়িত যায়া ছওয়া-পোয়াগুলেক বুঝিয়া স্কুলে ডাকে আনছি। তখন তিনশত ছওয়া-পোয়া আছিল। এখন এতগুলে নাই। ভালো শিক্ষক নাই। তাই আর কি ছওয়াগুলেও অন্য স্কুলে চলি গ্যাইছে।’ ২০০৮ সালে চালু হওয়া বিদ্যালয়টিতে এখন ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। শিক্ষার্থী ১৩৯ জন। শিক্ষক ৯ জন। বিদ্যালয়টি এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি।

বিনা বেতনের মাস্টার

শুরুর দিকে খুব উৎসাহের সঙ্গে চললেও ধীরে ধীরে বিদ্যালয়টিতে লেখাপড়ার মান নিম্নগামী হতে শুরু করে। মোসলেম একদিন স্কুলে শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময় করলেন। সপ্তম শ্রেণিতে গিয়ে দেখলেন, শিক্ষার্থীরা গল্প করছেন। জানলেন, ইংরেজি স্যার আসেননি। তিনি প্রায়ই আসেন না। শিক্ষার্থীদের জন্য মোসলেমের মায়া লাগে। তিনি বই নিয়ে পড়াতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা খুশি হয়। পরদিনও মোসলেম স্কুলে গিয়ে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস নিলেন। তাঁর পাঠদানের আন্তরিকতায় মুগ্ধ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। সেই থেকে এভাবে টানা ১৫ বছর ইংরেজি পড়াচ্ছেন তিনি। বিনা বেতনে। ‘মুই শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করি পড়াং। বেতন-ভাতার কথা চিন্তা করি না। ছওয়াগুলে আমাক দাদু কয়া ডাকায়। এতে মুই মেলা আনন্দ পাই।’ বললেন মোসলেম।

এখন মোসলেমের মন পড়ে থাকে স্কুলে। শিক্ষার আলো বিলাতেই ভালোবাসেন তিনি। বললেন, ‘অল্প অ্যাকনা জমি চাষাবাদ করি, গ্রামের বাড়িত প্রাইভেট পড়ায়ে সামান্য যা টাকা দেয়, সেইটা দিয়া কোনো রকম সংসার চালাই। গরিব শিক্ষার্থীদের কাছ থাকি টাকা নিই না। ছেলেমেয়েদের পড়বার পায়া মোর মেলা ভালো লাগে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজটা করি যাবার চাং (চাই)।’
এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল

২০০৮ সাল থেকে এক দিনও স্কুল কামাই দেননি মোসলেম। ঝড়-বৃষ্টি কিংবা কাঠফাটা রোদ—কোনো কিছু আটকাতে পারেনি অদম্য এই মানুষটিকে। স্কুলে তিনি আসেন সবার আগে, যান সবার পরে। তাঁর প্রতি খুশি স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী সোমাইয়া আক্তার বলল, ‘স্যার খুব ভালো পড়ান।’

মোসলেমের ছাত্র ছিলেন নজরুল ইসলাম। এখন তিনি কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। বললেন, ‘স্যার খুব যত্ন নিয়ে আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। তিনি তো চাকরি করেন না, মনের টানে স্কুলে আসেন।’ কুড়িগ্রামে ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন আজিজুল ইসলাম। বললেন, ‘স্যার অনেক ভালো মনের মানুষ। বিনা বেতনে এত বছর ধরে কেউ পড়াচ্ছেন, এমনটি কোথাও দেখিনি।’ কালীগঞ্জ কলেজে অনার্স পড়ুয়া আল আমিন বললেন, ‘তাঁর কাছে ২০১৬ সালে পড়েছি। স্যারের এখন অনেক বয়স হয়েছে। তবু শিক্ষার্থীদের টানে স্কুলে আসেন।’

তাঁরা বললেন

উত্তরাধিকার সূত্রে ৬০ বিঘা জমি পেয়েছিলেন। দুই বিঘা বাদে সবই গেছে পদ্মার পেটে। সেই জমিই তাঁর সম্বল। প্রাইভেট পড়িয়ে পান সামান্য কয়টি টাকা। এরই মধ্যে সন্তানদের বিয়ে দিয়েছেন। তাদের আলাদা সংসার। এখন অভাবেই কাটে মোসলেমের। কিন্তু এতে স্ত্রী বেনোয়ারা বেগমের খেদ নেই। তাঁর স্বামীকে সবাই সালাম দেয়, স্যার ডাকে, এতেই খুশি তিনি। বললেন, ‘উনাক সবাই মোসলেম উদ্দিন স্যার কয়া ডাকায়। তাতেই উনি খুশি, হামরাও খুশি।’

বিদ্যালয়টির পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোবারক আলী বলেন, ‘বিদ্যালয়টি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষকদের দুঃখ কাটছে না।’ প্রধান শিক্ষক মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্কুলে ইংরেজির শিক্ষক নিয়মিত আসেন না। এ অবস্থায় মোসলেম উদ্দিনই একমাত্র ভরসা।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *