নোবেল পুরস্কার জয়ের কল পেয়ে বললেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি ক্লাস নিচ্ছি।

২০২৩ সালে পদার্থবিজ্ঞানে যে তিনজন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের একজন অ্যান ল’হুইলিয়ার। একই বছর তার সঙ্গে নোবেল পাওয়া অপর দুজন হলেন, পিয়েরে অ্যাগোস্টিনি, ফেরেঙ্ক ক্রাউস।

এই তিন পদার্থবিজ্ঞানী আলোর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত স্পন্দন তৈরি করার একটি উপায় দেখিয়েছেন। যা ইলেক্ট্রনের চলাচল বা শক্তি পরিবর্তনে দ্রুতগতির প্রক্রিয়া পরিমাপ করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। তাদের অবদানের ফলে দ্রুতগতির এ প্রক্রিয়াগুলো অনুসন্ধান করা সম্ভব হয়েছে, যা আগে অসম্ভব ছিল।

অ্যান ল’হুইলিয়ারের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার কথা জানার মুহূর্তটি একটু আলাদা। যখন নোবেল অ্যাকাডেমির কাছ থেকে ফোনকল আসে তখন তিনি সুইডেনের লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করছিলেন। নোবেল কর্তৃপক্ষ থেকে অ্যাডাম স্মিথ নামের এক ব্যক্তি অপর প্রান্ত থেকে কথা বলার জন্য সময় চান। অ্যানি জানান, আমি একটু ব্যস্ত, শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছি। পরে পূর্বনির্ধারিত বিরতিতে তিনি ফোনকল সারেন।

এসময়ই তিনি জানতে পারেন এবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ীদের একজন তিনি। এমন একটি সংবাদ পাওয়ার পর তিনি পুনরায় শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করেন এবং পাঠদান চালিয়ে যান।

গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, নোবেল অ্যাকাডেমি থেকে তিনি যখন ফোনকল পান তখন তিনি পাঠদানের মধ্যে ছিলেন। ফোনকলটি তার ক্লাস শেষ করার বিষয়টি ‘কঠিন’ করে দেয়।

এদিকে নোবেল অ্যাকাডেমি তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ঘটনাটির বর্ণনা তুলে ধরতে ভোলেনি। তারা লিখেছে-

‘নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের কথা!

পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারও যাকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আলাদা করতে পারেনি।

আমাদের নতুন এ নোবেলজয়ী শ্রেণিকক্ষে ব্যস্ত ছিলেন। পূর্বনির্ধারিত বিরতিতে তিনি খবরটা শোনেন।

ফোনকল শেষ হলে তিনি আবার ক্লাসে ফিরে যান।’

সারাবিশ্ব নোবেল পুরস্কার ঘোষণার খবরে উদ্বেলিত থাকলেও অ্যান তার শিক্ষার্থীদের এক মুহূর্তের জন্য ভোলেননি। নির্ধারিত বিরতিতে খবরটি শোনার পরেও তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে শ্রেণিকক্ষে ফিরে গেছেন। অনেকেই বলছেন, যোগ্য ব্যক্তিরা এমনই হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন-

‘ফরাসি পদার্থবিদ Anne L’ Huillier ক্লাস নিচ্ছিলেন। নোবেল কমিটি থেকে ফোন আসে কয়েকবার ধরেননি। তারপর ফোন ধরে ক্লাসের বাইরে আসেন। ফোন শেষে আবার ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। বড় মনের মানুষরাই বড় পুরস্কার পান।

তোমরা যারা নারীকে ঘরে বন্দি করতে চাও তারা দেখ এবং শিখ। নারীরা সুযোগ পেলে কত বড় কাজ করতে পারে। আরেক নারী Katalin Karikó এইবার মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। যেই নারী গোটা মানবজাতিকে করোনার অতিমারি থেকে পৃথিবীর সব দেশের সব ধর্মের- গোত্রের মানুষকে রক্ষা করেছে।’

অ্যান ল’হুইলিয়ার সুইডেনের লান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাটমিক ফিজিক্স বিষয়ের অধ্যাপক। তিনি অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্স গ্রুপের প্রধান।

নোবেল পুরস্কারও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আলাদা করেনি তাকে

এএফপি জানায়, ১৯৮৭ সালে তিনি আবিষ্কার করেন, গ্যাসের ভেতর ইনফ্রারেড লেজার লাইট ফেললে আলোর বিভিন্ন অতিস্বর জেগে ওঠে। নোবেল কমিটি জানায়, তিনি এ আবিষ্কারের পর অধিকতর গবেষণা চালিয়ে যান।

১৯০১ সালের পর থেকে অ্যান ল’হুইলিয়ার পঞ্চম নারী হিসেবে নোবেল পুরস্কার পেলেন। তার আগে মারি কুরি (১৯০৩), মারিয়া মেয়্যার (১৯৬৩), ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড (২০১৮), আন্দ্রেয়া ঘেজ (২০২০) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান।

তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খুবই আপ্লুত। খুব বেশি সংখ্যক নারী এ পুরস্কার পায় না। একারণে এটা আমার জন্য খুবই বিশেষ একটি পুরস্কার।’

অ্যান ল’হুইলিয়ার বিবাহিত এবং তার দুই পুত্র রয়েছেন। খুবই সাধারণ একটি পরিবার ও সন্তানঘেরা জীবন নিয়ে কীভাবে তিনি গবেষণা চালিয়ে যাবেন তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। তবে প্রেস কনফারেন্সে বয়সে তরুণ নারীদের তিনি বলেছেন, কেউ যদি বিজ্ঞানের ভুবনে তাদের ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চায় তাহলে তাদের উচিত এটা নিয়ে ‘স্রেফ এগিয়ে যাওয়া’।

এর আগে চিকিৎসাবিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল পুরস্কারজয়ীদের পর মঙ্গলবার (০৩ অক্টোবর) পদার্থে নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়।

প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার থেকে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। আর প্রথম দিন চিকিৎসাশাস্ত্রের নোবেল ঘোষণা করা হয়। নোবেল বিজয়ীদের নাম ছয়টি বিভাগে মোট ছয় দিন ঘোষণা করা হয়। নোবেল শান্তি পুরস্কার ঘোষণা হয় নরওয়ে থেকে। সাহিত্য ও অর্থনীতির মতো অন্য পুরস্কারগুলো সুইডেন থেকে ঘোষণা করা হয়।

চিকিৎসা, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, সাহিত্য ও শান্তিতে পুরস্কারগুলো সুইডেনের বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের নামে ও তার রেখে যাওয়া অর্থে দেওয়া হয়। সুইডিশ শিল্পপতি নোবেল ডিনামাইটের উদ্ভাবক ছিলেন। তার মৃত্যুর পাঁচ বছর পর ১৯০১ সাল থেকে এ পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়।

পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় অর্থনীতি। ১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেলের অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে অবদানের কথা স্মরণ করে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।

এ বছর থেকে পুরস্কারের অর্থমূল্য ৮৯ হাজার মার্কিন ডলার বাড়িয়ে ৯ লাখ ৮৯ হাজার ডলার করা হয়েছে (১১ লাখ ক্রোনা)।

বুধবার (০৪ অক্টোবর) রসায়নে নোবেল বিজয়ী বা বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। এরপর ৫ অক্টোবর সাহিত্যে আর ৬ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম জানা যাবে। দুদিন বিরতি দিয়ে ৯ অক্টোবর ঘোষণা করা হবে অর্থনীতির নোবেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *