নির্বাচনকেন্দ্রিক ভোগান্তির শঙ্কা প্রার্থী ও ভোটারদের এনআইডির তথ্য চুরি ও সার্ভার..

দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিকের তথ্য চুরি, বারবার জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন (এনআইডি) সার্ভার বন্ধ ও হ্যাকারদের সাইবার হামলার হুমকি আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।

নির্বাচনকেন্দ্রিক সেবায় নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে পারেন ভোটার ও প্রার্থীরা। এমনকি ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে নানা বিপত্তি। সেইসঙ্গে পাসপোর্টপ্রত্যাশী নাগরিকরাও বিপাকে পড়তে পারেন। ফলে এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের আরও সতর্ক ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন নির্বাচন ও সাইবার বিশেষজ্ঞরা।

গত জুলাইয়ে লাখ লাখ না’গরিকের তথ্য ফাঁস নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়ের পর এবার ‘টেলিগ্রাম’ নামে একটি অ্যাপের মাধ্যমে তথ্য ফাঁস নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছে। ওই অ্যাপের মাধ্যমে কোটি মানুষের মোবাইল নম্বরসহ ব্যক্তিগত তথ্য উন্মুক্ত হওয়ায় বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়।

এ ঘটনায় মো”বাইল অপারেটরসহ সব পার্টনার সার্ভিসকে নজরদারিতে রেখেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। একই সঙ্গে সন্দেহভাজন প্রতিষ্ঠানকে এনআইডি সম্পর্কিত সার্ভিস দেওয়া বন্ধ

।রাখা হয়েছে। সেইসঙ্গে ঘটনা তদন্তে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ। তথ্য ফাঁসের সঙ্গে কোনো প্রতিষ্ঠানের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এর আগে একটি সাইটে বাংলাদেশের একটি সরকারি সংস্থার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে গত ৮ জুলাই খবর বের হয়। এসব তথ্যের মধ্যে

রয়েছে নাগরিকের নাম, ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা ও জাতীয় পরিচিতি নম্বর। নাগরিকদের অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যক্তিগত এসব তথ্য ফাঁসের এ ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। শুরুতে অস্বীকার করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে পরে তথ্য ফাঁসের ঘটনাকে স্বীকার করে নেওয়া হয়।

এরপর ১৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সাইটে একযোগে সাইবার হামলার হুমকি দেয় হ্যাকার গ্রুপ। তাদের এ হামলা ঠেকাতে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় সরকার। বন্ধ করে দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনের এনআইডিসহ সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সার্ভার।

এর পরও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশসহ (আইসিবি) অন্তত ২৫টি সাইটে হ্যাকাররা হামলা চালায় বলে জানা গেছে। এরপর থেকে প্রতিনিয়তই সাইবার হামলার হুমকি দিচ্ছে হ্যাকাররা। নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের ধারণা, যারা এসব তথ্য চুরি বা ফাঁস করেছে তারা নিশ্চয়ই কোনো টার্গেট নিয়েই করেছে। যে কোনো নাগরিকের গুরুত্বপূর্ণ চারটি তথ্য কোনো হ্যাকার বা অপরাধীর কাছে উন্মুক্ত


হয়ে পড়লে, তা বড় রকম ক্ষতির কারণ হতে পারে। ব্যাংকে হিসাব খোলা, এটিএম কার্ড তৈরিসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ এনআইডির মাধ্যমে করা হয়। তথ্য চুরি হয়ে গেলে এসব ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হতে পারে। এ ছাড়াও এনআইডি দিয়ে একজন নাগরিক তার ব্যক্তিগত মোবাইলের সিম উত্তোলন করে ব্যবহার

।করেন। দেশ-বিদেশে ব্যবসায়িক যোগাযোগ রক্ষাসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে এটি ব্যবহার করা হয়। এনআইডি নম্বর কোনো হ্যাকার বা অপরাধীর কাছে চলে গেলে নকল সিম উত্তোলনের মাধ্যমে ব্যক্তির বড় ধরনের ক্ষতি করা সম্ভব।

ইমেইলও এক ধরনের যোগাযোগ মাধ্যম। এতে ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম যাতে তথ্যও সংরক্ষণ করা হয়। এগুলো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে অপরাধী চক্র সুযোগ নিতে পারে। নানা ধরনের নাশকতার কাজেও ব্যবহার হতে পারে এসব তথ্য।

  • ফিলিস্তিনিদের নামে কাউকে চাঁদা না দেওয়ার অনুরোধ রাষ্ট্রদূতের
  • ঢাকায় যে হাসপাতালে মিলবে কম টাকায় মিলবে বিশ্বমানের সেবা

    তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে টার্গেট করে এসব তথ্যের মাধ্যমে অপরাধীরা অন্যের পরিচয় ধারণ করে অপপ্রচার, ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার মতো কার্যক্রমও পরিচালনা করতে পারে, যা প্রার্থী ও ভোটারদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

    পাশাপাশি বারবার এনআইডি সার্ভার বন্ধ করে দেওয়ায় ভোগান্তিতে পড়তে পারেন ভোটার ও প্রার্থীরা। সার্ভার বন্ধের কারণে ভোটার আইডি সংশোধন ও ঠিকানা স্থানান্তরসহ নানা জটিলতায় পড়তে পারেন তারা। বিশেষ করে নির্বাচনের তপশিলের পর সার্ভার বন্ধ হলে নির্বাচনের প্রার্থীরা চরম বিপাকে পড়তে পারেন।

    সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া অটোমেশন না হওয়ায় ভোটে হয়তো সরাসরি প্রভাব পড়বে না। কিন্তু যেহেতু অনেক মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়েছে, কাজেই তাদের পরিচয় কিন্তু অপরাধীরা ধারণ করতে পারে। অর্থাৎ ফাঁস হওয়া তথ্য ব্যবহার

    করে অপরাধীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সেখান থেকে অপপ্রচার, গুজব, মিথ্যা সংবাদ প্রচার করতে পারে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এসব বিষয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটি মনোনয়নপ্রত্যাশীদের জন্য কিছুটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো বিষয়।’

    জোহা বলেন, ‘পুলিশের ক্রিমিনাল ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (সিডিএমস) রয়েছে যেখানে অপরাধীদের বিভিন্ন তথ্য থাকে। কোনো হ্যাকার কাউকে বিপাকে ফেলার জন্য এই ডাটাবেজে তাকে দাগী আসামি করে প্রোফাইল তৈরি করতে পারে। কাজটি কঠিন হলেও যদি তা করে ফেলে, তাহলে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা বিপাকে পড়তে পারেন। ফলে নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্টদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।’

    অন্যদিকে নির্বাচনের সময়ে নাগরিকদের উপাত্ত ব্যবহার করে মিথ্যা তথ্যসংবলিত বিজ্ঞাপন প্রচারের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আব্দুল্লাহ আল জাবের বলেন, ‘এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় একটা বড় ভূমিকা রাখবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ফেসবুকে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য বিজ্ঞাপন দিতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্টের মতো দলিল দিয়ে

    ‘অ্যাড অ্যাকাউন্ট’ ভেরিফাই করতে হয়। এ ধরনের তথ্য কারও কাছে থাকলে সে অসৎ উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারেন। অন্যের এনআইডি বা পাসপোর্ট ব্যবহার করে ফেসবুক অ্যাড অ্যাকাউন্ট ভেরিফাই করে সেখান থেকে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’

    জানতে চাইলে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির (ডিএসএ) মহাপরিচালক আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান কালবেলাকে বলেন, ‘নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অপপ্রচার, গুজব এবং মিথ্যা পরিচয়ে

    রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) সভা হয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছে। আমরাও বিষয়গুলো আমাদের তদারিকতে রাখব। আইনে আমাদের যেসব দায়িত্ব ও সুযোগ দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আমরা অবশ্যই প্রয়োগ করব।’

    জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ কালবেলাকে বলেন, ‘নাগরিকদের তথ্যের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন খুব সতর্ক রয়েছে। নির্বাচন কমিশন থেকে এসব তথ্য ফাঁস হচ্ছে না। এসব তথ্যের ব্যাপারে ১৭৪টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কমিশনের চুক্তি রয়েছে। তাদের মধ্য থেকে এ অপকর্ম হতে পারে। তবে ভোটে এসব তথ্যফাঁস তেমন কোনো প্রভাব পড়বে বলে আমরা মনে করি না।’

    এনআইডি অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘নাগরিকের তথ্য ফাঁসে ইসির কোনো দুর্বলতা নেই। ইসি থেকে এসব তথ্য হ্যাকও হয়নি। কারণ ইসির টেকনিক্যাল দিকটা

    খুব স্ট্রং। তারা সবসময় এটা মনিটর করে থাকে। নাগরিকদের তথ্য ফাঁস নিয়ে যেসব জায়গা সন্দেহভাজন, তাদের সেবা আমরা এরই মধ্যে বন্ধ করে দিয়েছি। এ ছাড়া তদন্ত কমিটিও কাজ করছে। যে দোষী হবে তাকে আইনের আওতায় নেওয়া হবে।’

    উল্লেখ্য, এনআইডি সার্ভারে ১২ কোটি নাগরিকের তথ্য রয়েছে। তাদের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি নাগরিকের স্মার্ট এনআইডি আছে। এ ছাড়া ১০ লাখ রোহিঙ্গার তথ্যও রয়েছে এই সার্ভারে। বারবার নাগরিকের তথ্য ফাঁসের পেছনে কে বা কারা রয়েছে,

    তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না ইসির এনআইডি শাখার সিস্টেম ম্যানেজমেন্ট। তবে এনআইডি সার্ভারে প্রবেশাধিকার রয়েছে, এমন ১৭৪টি সংস্থার কোনো একটির মাধ্যমেই এসব তথ্য ফাঁস হয়েছে বলে তারা চিহ্নিত করতে পেরেছে।

  • Leave a Reply

    Your email address will not be published. Required fields are marked *