নিঃস্ব লাখো মানুষ এমটিএফইয়ের প্রতারণা : লোভের বিনিয়োগ এখন ঋণের বোঝা

দুবাইভিত্তিক এমএলএম কম্পানি মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জে (এমটিএফই) বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হয়েছেন দেশের লাখো মানুষ। ভুক্তভোগীরা জানান, এই অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খোলার পর বিনিয়োগের ওপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা হতো। হঠাৎ করেই অ্যাকাউন্ট থেকে তাঁরা আর টাকা তুলতে পারছিলেন না। প্রতারণা করে তাঁদের টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে এমটিএফই।

লাভের আশায় গিয়ে ঋণের বোঝা ধরিয়ে দিয়েছে এমটিএফই। এতে যাঁরা দ্রুত আয় করার স্বপ্ন নিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন, তাঁরা এখন হাহুতাশ করছেন।
গ্রাহকদের ট্রেডিং থেকে উপার্জন এবং অর্থ পরিশোধের কথা বলে অ্যাপটি ব্যবহারকারীদের অবিশ্বাস্য সহজ পথে অর্থ আয়ের আমন্ত্রণ জানায় এমটিএফই অ্যাপ। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রায় সব ব্যবহারকারীর ভার্চুয়াল অ্যাকাউন্ট ঋণাত্মক দেখানো শুরু করে অ্যাপটি।

স্বয়ংক্রিয় লেনদেনের পর বিপুল লোকসান হয়েছে বলে দাবি করেছে অনিয়ন্ত্রিত এই সংস্থা। গ্রাহকদের বিভিন্ন দলের নেতারা অনুমান করছেন, এই সংখ্যা এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ হতে পারে। তাঁদের ধারণা, এই কাণ্ডে প্রায় হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

বাংলাদেশের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, এমএলএম ব্যবসা পরিচালনা এবং ক্রিপ্টো কারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ।

এর পরও কমপক্ষে ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করলে দিনশেষে পাঁচ হাজার টাকা লাভ হবে—এমন কল্পিত মুনাফার লোভে শত শত মানুষ বিনিয়োগ করেন এই কম্পানিতে। অনেকে গয়না ও মূল্যবান সামগ্রী বন্ধক রেখেও বিনিয়োগ করেছিলেন।
জয়পুরহাট : জয়পুরহাটে ১১ কোটি টাকা প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে। জেলার বিভিন্ন এলাকার প্রায় এক হাজার যুবককে প্রতিদিন মোটা অঙ্কের লভ্যাংশে প্রলুব্ধ করে তাঁদের কাছ থেকে এই টাকা হাতিয়ে নিয়ে জেলার সাতজন সিইও সাইট বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁরা হলেন সাদ আলম চৌধুরী, তামান্না আক্তার সুরভি, সুমন খন্দকার, মইনুল হোসেন, মোশারফ হোসেন, আল হোসেন রাব্বি ও শহিদুল আলম চৌধুরী।

জেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকার প্রতারিতদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

নওগাঁ : নাম প্রকাশ না করার শর্তে নওগাঁ বাজারের একাধিক ভুক্তভোগী জানান, লাভের আশায় ধার করে এক লাখ টাকা, কেউ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছিলেন। কিছুদিন তারা ওই টাকার ওপর লাভও দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে কয়েক দিন আগে থেকে অ্যাপটি থেকে টাকা ওঠানো বন্ধ করে দেয়।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ : চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের এক ব্যক্তি পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যাঁরা অ্যাপভিত্তিক এমএলএম ব্যবসায় যুক্ত তাঁদের অনেকেই চক্রটি সম্পর্কে জানেন। প্রতারণার স্বীকারও হয়েছেন অনেকে। দুই দিন থেকে অ্যাপটি বন্ধ রয়েছে। অনেকেই এখন মুখ বন্ধ রেখেছেন। মোবাইল সারানোর এই কারিগর বহুদিন ধরে বিভিন্ন রকম এলএমএল ব্যবসায় যুক্ত। তবে তিনি নিজে অ্যাপের কারবারে জড়িত নন বলে দাবি করেন।

রাজশাহী : এমটিএফইয়ের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছেন রাজশাহীর হাজারো মানুষ। যাদের মধ্যে বেশির ভাগই বেকার। তাঁরা চাকরি না পেয়ে ধার-দেনা করে, কেউবা জমি বন্ধক রেখে ওই অ্যাপে টাকা লগ্নি করেন।

রাজশাহী নগরীসহ জেলার ৯টি উপজেলার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ এই অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন বলেও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। আর এই বিপুল মানুষের কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকচক্রটি। রাজশাহী নগরীর লক্ষ্মীপুর এলাকার বাসিন্দা সেলিম উদ্দিন জানান, কিছুদিন আগে তিনি ধার করে ৬০ হাজার টাকা জমা দিয়েছিলেন এমটিএফইতে। দুই-তিন দিন তিনি টাকাও উত্তোলন করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি ১০ হাজার টাকার মতো উত্তোলন করতে পেরেছিলেন।

কুমিল্লা : কুমিল্লা থেকেই চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি। জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার শিকার হয়েছেন মুরাদনগর উপজেলার যুবকরা। ওই অ্যাপে বিনিয়োগ করতে স্থানীয় টিম লিডার হিসেবে কুমিল্লা নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে যুবকদের যাঁরা উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাঁদের প্রায় সবাই মুরাদনগর উপজেলার বাসিন্দা।

কুমিল্লা নগরীর চর্থা এলাকার বাসিন্দা মনির আহমেদ জানান, রাতারাতি ধনী হতে গিয়ে প্রতারিত হয়েছেন যুবকরা। মূলত এমটিএফই নামের অ্যাপটিতে কাজ করত সংঘবদ্ধ একটি চক্র। এই চক্রটি গ্রাহকদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে নানা তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে অ্যাপটি পরিচালনা করত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *