দিনমজুর থেকে শিক্ষা ক্যাডার, গবাদিপশুর সঙ্গে কাটতো রাত

কখনও দিনমজুর, কখনও ঢাকায় সিকিউরিটি গার্ডসহ নানা পেশায় কাজ করেও বিসিএস জয় করেছেন কুড়িগ্রামের উলিপুরের মো. জিয়াউর রহমান। দারিদ্রতার শত কষাঘাতেও লেখাপড়ার হাল ছাড়েননি তিনি। অবশেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাশ করে ৪১তম বিসিএস এ শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন জিয়াউর রহমান। তার এ সাফল্যে খুশি পরিবার, স্থানীয় ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

নিজের লেখাপড়া চালানোর সামর্থ ছিল না জিয়াউর রহমানের। ফরম পূরণের টাকা ছিল না, অর্থাভাবে দিনমজুরের কাজ করতে হতো তাকে। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। অভাবের কারণে নিজের থাকার জায়গা পর্যন্ত ছিলনা, জরাজীর্ণ ঘরে রাত কাটতো গবাদিপশুর সঙ্গে। সেই জিয়াউর রহমান এখন বিসিএস ক্যাডার।

কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার ধরনীবাড়ী ইউনিয়নের বাকারায় মধুপুর দালালীপাড়া গ্রামের ছকিয়ত আলীর ছেলে জিয়াউর রহমান। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় শিক্ষা ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি।

জানা গেছে, জিয়াউর রহমানের বাবা ছকিয়ত আলী ধনুষ্টংকার রোগে আক্রান্ত হয়ে কর্মহীন। ৩ শতক জমিতে বসতভিটা। অন্যের বাড়িতে কাজ করতেন তার মা। শত প্রতিকূলতার মাঝে ২০১২ সালে উপজেলার নতুন অনন্তপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান জিয়াউর রহমান। আলিমে ভর্তি হয়ে অর্থকষ্টে পড়াশুনা চালিয়ে নেওয়ার সামর্থ্য ছিল না তার। পরে বই কেনার টাকা জোগাড় করতে ঢাকায় যান। সেখানে একটি দোকানে কাজ করে কিছু টাকা জমিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন।

কিন্তু বই কেনা হয়ে উঠে না তার। ছোট বোনের বিয়ের জন্য সব টাকা শেষ হয়ে যায়। এরপর অর্থের জন্য মুন্সীগঞ্জের আকিজ ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে গিয়ে কিছুদিন কাজ করে পুনরায় বাড়িতে এসে পড়াশোনা শুরু করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যের জমিতে কাজ করে সংসার চালাতেন তিনি। প্রতিকূলতার মাঝে ধরনীবাড়ী লতিফ রাজিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা থেকে ২০১৪ সালে আলিম পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ-৪.৬৭ পেয়ে উত্তীর্ণ হন।

জিয়াউর রহমান বলেন, স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে প্রশাসন ক্যাডার হওয়ার। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতির কোচিং করার অর্থ ছিল না। তাই ঢাকায় গিয়ে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি শুরু করি। সেখানে কাজের চাপে পড়াশুনার তেমন কোনো সুযোগ ছিল না। ২০১৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ওই বছরই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মিরপুর বাঙলা কলেজে সুযোগ পেলেও অর্থের অভাবে ভর্তি হননি।

তিনি আরও বলেন, ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার, সেভাবে প্রস্তুতিও নেই। কিন্তু ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২য়বার ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যায়। পরীক্ষা দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। পরে ২০১৫ সালে ভর্তি হই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে। কিন্তু কিভাবে পড়াশোনার খরচ জুটবে সেই নিশ্চয়তা ছিল না। থাকা, খাওয়া ও সামান্য কিছু হাত খরচের টাকার জন্য খণ্ডকালীন কাজ করি। এছাড়া টিউশনি, কোচিংয়ে ক্লাস নিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করে ২০১৯ সালে অনার্সে সিজিপিএ ৩.৪১ পেয়ে উত্তীর্ণ হই।

তিনি বলেন, করোনা মহামারি শুরু হলে আবার আর্থিক সংকটে পড়ি। এর মধ্যেই ২০২০ সালে মাস্টার্সে সিজিপিএ ৩.৪৬ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। শেষে অনেকের সহযোগিতায় ও টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নেই। অবশেষে কপালে জুটে যায় শিক্ষা ক্যাডার। বিসিএসের রেজাল্ট যেদিন প্রকাশ হয় সেদিন শিক্ষা ক্যাডারে নিজের রোলটি দেখে চোখে পানি চলে এসেছিল। তবে ইচ্ছা ছিল প্রশাসনে চাকরি করার কিন্তু যা হয়েছে তাই নিয়ে অনেক খুশি এখন।

জিয়াউর রহমানের বাবা ছকিয়ত আলী জানান, আমার বাড়ি ভিটার তিন শতক জমি ছাড়া আর কিছু নেই। দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাতে হয়। জিয়াউরের মা অন্যের বাড়িতে কাজও করেছে। এই পরিবার থেকে ছেলের জন্য কিছু দেয়া সম্ভব হয়নি। বরং ছেলেই আমাদেরকে দিয়েছে। ছেলে বড় চাকরি পেয়েছে এতে আমি খুশি।

জিয়াউর রহমানের মা জেলেখা বেগম বলেন, ছেলে সংসার চালিয়ে খুব দুঃখ-কষ্ট করে পড়াশোনা করেছে। আমরা তাকে কিছুই দিতে পারি নাই। আজ ছেলের ভালো খবরে আমরা সবাই খুশি। ছেলে যখন ফোন করে জানালো ‘মা আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি, তখন বুঝতে পারিনি বিসিএস ক্যাডার কি জিনিস’। পরে বুঝিয়ে বলার পর আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। আমার ছেলের জন্য সবাই দোয়া করবেন। সে যেন একজন ভালো মানুষ হতে পারে।

ধরনীবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এরশাদুল হক বলেন, জিয়াউর রহমান খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। কখনো দিনমজুর, কখনো টাইলস মিস্ত্রির কাজ করে পড়াশোনা করে বিসিএস পাশ করেছে। সে আমাদের ইউনিয়নের গর্ব।

ধরনীবাড়ী লতিফ রাজিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এ, টি, এম, বরকতউল্লাহ জানান, তার আলীম পরীক্ষার ফরম পূরণের টাকা ছিল না। পরে আমি নিজে তার বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্র নিয়ে এসে ফরম পূরণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। সে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে এতে আমরা খুশি। আমরা আশা করি সে যেন মানুষ গড়ার কারিগর হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *