ছাত্রলীগের হাত ধরে সিলেটের বাজারে চোরাই চিনি

দেশে চিনির দাম বেড়ে যাওয়ায় সিলেট জেলার সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেদার ঢুকছে ভারতীয় চিনি। প্রতিদিনই গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার উপজেলা সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে কোটি টাকার চিনি। এ ছাড়া আসে অন্যান্য পণ্য গরু-মহিষের চালানও। এসব চোরাচালানের ঘটনায় সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।

চোরাচালানের চিনি পাইকারি বাজারে পৌঁছে দিতে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী সহায়তা করার অভিযোগ নিয়ে ফেসবুকে কথা বলায় গত ১০ আগস্ট রাতে নিজ বাসায় হামলার শিকার হন ছাত্রলীগের সাবেক কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং সিলেট জেলা ও দায়রা জজ আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট প্রবাল চৌধুরী। সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তার বাসভবনে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। তিনি গুলিতে আহত হন। এ ঘটনায় মামলা করেছেন তিনি।

ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা বলছেন, ভারতে প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ টাকায়। অথচ একই মানের চিনি বাংলাদেশের মানুষকে কিনতে হচ্ছে ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা কেজি দরে। এ কারণে চোরাইপথে চিনি আসা বেড়ে গেছে। এসব চিনি সিলেটের পাইকারি বাজার কালীঘাটে বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন সেখানে প্রায় কোটি টাকার চোরাই চিনি কেনাবেচা হয়। এরপর দেশীয় নানা ব্র্যান্ডের স্টিকারযুক্ত বস্তায় ভরে সেগুলো পাঠানো হয় বিভিন্ন এলাকায়। চোরাইপথে আসা এসব চিনি ভারতীয় বুঙ্গার চিনি নামে পরিচিত।

ব্যবসায়ীরা জানান, ছাত্রলীগের কয়েকটি পক্ষ এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত। গোয়াইনঘাটের জাফলং-তামাবিল-জৈন্তাপুর-হরিপুর সড়ক দিয়ে চিনির ট্রাক নগরের বাইপাস এলাকায় পৌঁছালে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী মোটরসাইকেল পাহারায় সেগুলো কালীঘাটে পৌঁছে দেন। একইভাবে কোম্পানীগঞ্জ-সিলেট সড়ক দিয়ে আসা চোরাই চিনির ট্রাকগুলো সালুটিকর ও ধোপাগুল এলাকা থেকে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী পাহারা দিয়ে কালীঘাটে দিয়ে আসেন। এজন্য তারা ট্রাকপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পান।

এসব নিয়ে বিরোধের জেরে গত ১৩ আগস্ট সিলেট মহানগর হাকিম প্রথম আদালতে ছাত্রলীগের ৫৫ নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের সহকারী সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা প্রবাল চৌধুরী। মামলায় উল্লেখ করা হয়, অভিযুক্তরা চিনি চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত। বাদী ফেসবুকে চিনি চোরাকারবারি ও অছাত্র দিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের বিষয়ে প্রতিবাদমূলক স্ট্যাটাস দেন।

মামলায় জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজ এবং মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মো. নাঈম আহমদ, সিটি করপোরেশনের ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত কাউন্সিলর রুহেল আহমদ, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মিছবাউল করিম ওরফে রফিক, জকিগঞ্জ উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আতিকুল আলমের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর জেরেই প্রবাল চৌধুরীর ওপর হামলা হয়। তিনি গুলিতে আহত হন।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাজমুল ইসলাম, রাহেল সিরাজ ও মো. নাঈম আহমদ বলেন, ছাত্রলীগের কেউ চিনি চোরাচালানে সম্পৃক্ত নন। উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি পক্ষ তাদের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে এসব রটাচ্ছে। প্রবাল চৌধুরীর ওপর তারা কোনো হামলা করেননি বলেও জানান।

কালীঘাটের ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন ২৫-৩০টি ট্রাক আসে। একেকটি ট্রাকে গড়ে ৬৫ থেকে ৭০ বস্তা চিনি থাকে। সে হিসাবে কমবেশি ২ হাজার ১০০ বস্তা ভারতীয় চিনি এখানে বেচাকেনা হয়। এর বাইরে কালীঘাট ঘেঁষা সুরমা নদী দিয়েও প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ বস্তা চোরাই চিনি এখানে আনা হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতি বস্তা ভারতীয় চিনি ৫ হাজার ৯০০ টাকায় কেনেন। সে হিসাবে প্রতিদিন এক থেকে দেড় কোটি টাকার চোরাচালানের চিনি কেনাবেচা হয়। পরে তা বাজারদরে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা হয়।

তারা আরও জানান, দেশীয় ও আমদানি করা চিনি প্রতি ৫০ কেজির বস্তা ৬ হাজার ২৪০ টাকায় কেনেন এবং তা পাইকারি দরে বিক্রি করেন ৬ হাজার ২৫০ টাকায়। অন্যদিকে চোরাচালানে আসা ৫০ কেজির চিনির বস্তা তারা ৫ হাজার ৮৫০ টাকায় কেনেন। পাইকারি দরে এসব চিনি বিক্রি করেন ৫ হাজার ৯০০ থেকে ৬ হাজার টাকায়। বৈধ পথে আসা প্রতিটি চিনির বস্তায় লাভ হয় ১০ টাকা আর চোরাচালানের চিনিতে লাভ হচ্ছে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা।

এ প্রসেঙ্গ বিজিবি সিলেটের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সেলিম হাসান কালবেলাকে জানান, ১ জুলাই থেকে ১০ আগস্ট পর্যন্ত আমরা ২ লাখ ৬৭ হাজার কেজি চিনি জব্দ করেছি। প্রতিদিনই আমরা ৮ থেকে ১০ হাজার কেজি চিনি জব্দ করছি।

সিলেট জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) সম্রাট তালুকদার বলেন, গত জুলাইয়ে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত ১৩ জন, আগস্টে ৮১ জন, এবং চলিত মাসে এ পর্যন্ত পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধ ভারতীয় বিভিন্ন পণ্য জব্দ করা হয়েছে। তার মধ্যে ৯১ হাজার ৩০০ কেজি চিনি, নাসির বিড়ি ৩ লাখ ৯১ হাজার শলাকা, চা পাতা ১ হাজার ৬০০ কেজি, ৫৮টি গরু, মহিষ ৬৩টি, কাপড় ১ হাজার ৮১০ পিস, মোবাইল ফোন ২৯৭টি, অটোরিকশার টায়ার ৪৬টি, সিরাপ ১৬ বোতল, চোরাইয়ে ব্যবহৃত ছয়টি সিএনজিচালিত অটোরিকশা, একটি কার, দুটি পিকআপ ভ্যান, তিনটি মিনি ট্রাক, তিনটি বড় ট্রাক ও ১২টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা রয়েছে।

সিলেট মহানগর পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার আজবাহার আলী শেখ কালবেলাকে জানান, অবৈধভাবে ভারতীয় পণ্য সিলেটে প্রবেশ বন্ধে অভিযান অব্যাহত রয়ছে।

সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শেখ সেলিম বলেন, চোরাচালান বন্ধে জেলা পুলিশ জিরো টলারেন্স ঘোষণা করে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় আছে। সীমান্তে চোরাচালানের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিযানের মাধ্যমে সেগুলো উদ্ধার করছি। চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে আমাদের এ অভিযান চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *