দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি এবং মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে দীর্ঘদিন ধরেই মানবেতর জীবনযাপন করে আসছেন গার্মেন্ট শ্রমিকরা। বর্তমান মজুরিতে সংসার আর চলছে না—এমন দাবি জানিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই তা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন তারা। শ্রমিকদের এ দাবিকে যৌক্তিক ও সময়োপযোগী মনে করে এরই মধ্যে মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। নতুন কাঠামো নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। সেখানে শ্রমিকদের পাশাপাশি প্রতিনিধি পাঠিয়েছেন মালিকরা। অর্থাৎ, মজুরি বৃদ্ধির প্রশ্নে একমত তারাও। বলা হচ্ছে, খুব দ্রুতই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে বোর্ড।
তবে সেখানে মজুরি নির্ধারণ করতে গিয়ে কাছাকাছি আসতে পারছেন না মালিক ও শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধিরা। মজুরি বোর্ডের কাছে ন্যূনতম মজুরি ১০ হাজার ৪০০ টাকা প্রস্তাব করেছেন মালিকরা। আর এতেই সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন শ্রমিকের একাংশ। সেখান থেকেই পোশাক শিল্পে গত কয়েকদিনের অসন্তোষের সূত্রপাত। শুরুতে শান্তিপূর্ণ থাকলেও আন্দোলন শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। অবশ্য শ্রমিকদের এমন ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠার পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করছে সরকার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং মালিক সংগঠনের নেতারাচার দিন ধরে ন্যূনতম মজুরি ইস্যুতে গাজীপুর ও ঢাকার মিরপুরে গার্মেন্ট এলাকাগুলো এখন রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। শ্রমিকরা কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও সহিংস মিছিলে যোগ দিয়েছে। এরই মধ্যে এতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। এমন এক সময়ে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির যৌক্তিক দাবিটি তীব্র হয়ে ওঠেছে, যখন জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে দেশের রাজনীতিও রক্তক্ষয়ী সহিংসতায় গড়িয়েছে।
একদিকে শ্রমিক আন্দোলন, অন্যদিকে রাজনৈতিক আন্দোলন—উভয় ক্ষেত্রেই আন্দোলনের অভিন্ন রূপ দেখে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এখন এর যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করছে। সার্বিক বিষয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ থেকে চিঠি দিয়েও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে অবহিত করা হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন গার্মেন্ট মালিকরা নিজেদের মধ্যেও নতুন করে শলাপরামর্শ করছেন। তারা এরই মধ্যে শ্রম অসন্তোষ নিরসনে আগের দেওয়া প্রস্তাব (১০ হাজার ৪০০ টাকা) প্রত্যাহার করে ন্যূনতম মজুরি আরও বাড়িয়ে নতুনভাবে নির্ধারণ করে মজুরি বোর্ডের কাছে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একই সঙ্গে সংক্ষুব্ধ শ্রমিকদের কাজে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, যেসব শ্রমিক আন্দোলন ছেড়ে কাজে যোগ দেবেন না, তাদের মজুরি বন্ধ করে দেওয়া হবে। অর্থাৎ, ‘নো ওয়ার্ক, নো পেমেন্ট’ পদ্ধতি তারা প্রয়োগ করবেন।
মজুরি বোর্ডের কাছে প্রত্যাশার চেয়ে কম মজুরি বাড়ানোর স্তাব দিয়ে শ্রমিকদের সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার সুযোগ কেন দেওয়া হলো জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি মো. ফারুক হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘মজুরি বোর্ড হলো একটি বার্গেনিং প্ল্যাটফর্ম (দরকষাকষির ক্ষেত্র)। সব পক্ষের প্রস্তাব সেখানে যাবে। মজুরি বোর্ড সেগুলো পর্যালোচনা করবে। এতে কারও বাড়তি প্রস্তাব থাকবে, কারও বা কম। এটা প্রাথমিক একটি উদ্যোগ। এরপর চূড়ান্ত পর্যালোচনায় সেখানে যোগ-বিয়োগ হবে।’উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত ছিল ৫৩০০ টাকা। ২০১৮ সালে যখন মজুরি বোর্ড হলো সেখানে আমরা
১০০০ টাকা বাড়ানোর প্রাথমিক প্রস্তাব করেছিলাম। পরে মজুরি বোর্ড অোমাদের প্রস্তাবের সঙ্গে অতিরিক্ত ১২০০ টাকা যোগ করে। এই চূড়ান্ত প্রস্তাব যখন সরকারের নীতিনির্ধারণীতে পাঠানো হলো, তখন আরও ৫০০ টাকা যোগ হয়ে মোট বাড়ল ২৭০০ টাকা এবং মোট মজুরি দাঁড়াল ৮০০০ টাকা। কিন্তু এবার আমরা নিজেরাই ২৪০০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছি। এর সঙ্গে মজুরি বোর্ড তাদের পর্যালোচনার পর অতিরিক্ত যোগ করবেন। সবশেষ সরকারও বাড়াবে। যেহেতু আমাদের প্রস্তাবটি প্রাথমিক স্তরের, এই নিয়ে তো কোনো দায়িত্বশীল শ্রমিক সংগঠনের আন্দোলনে নামার কোনো সুযোগ নেই।’তিনি দাবি করেন, ‘আমরা স্পষ্ট বলে দিয়েছে, মজুরি বোর্ড ও সরকার নির্ধারিত মজুরি আমরা মেনে নেব। শ্রমিকরা যেন অনতিবিলম্বে নিজ নিজ কারখানায় কাজে যোগ দেয়। তবে যারা কাজ করবে না, তাদের মজুরিও থাকবে না। এর পরও পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে শ্রম আইনের ১৩-এর ১ ধারা অনুযায়ী আমরা কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবো।’
এক প্রশ্নের জবাবে ফারুক হাসান বলেন, ‘যে কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করে তারা সেই কারখানা ভাঙচুর করতে পারে না। নিজের সহকর্মীর রক্তও ঝরাতে পারে না। এখানে শ্রমিকদের তৃতীয় কোনো পক্ষ ইন্ধন দিচ্ছে, শান্তিপূর্ণ পরিবেশকে অশান্ত করে নিজেদের ফায়দা লুটতে চাইছে।’এ বিষয়ে প্রায় অভিন্ন মন্তব্য করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘শ্রমিকদের দাবি যৌক্তিক বলেই মালিক-শ্রমিক ও সরকার একমত হয়ে মজুরি বোর্ড গঠন করেছে। তারা মজুরি নিয়ে এখন কাজ করছে। কিন্তু এখনো যার ঘোষণাই হয়নি, তা নিয়ে এই আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতাই নেই। মূলত দেশে নির্বাচন ইস্যুতে যে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, রাজপথ থেকে বাড়তি ফায়দা লুটতে শ্রমিকদের উসকানি দিয়ে রাস্তায় নামাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত চক্র। তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বরাবরই এই হীন কাজটি করে থাকে।’তিনি বলেন, ‘আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পরিষ্কার বলে দিয়েছি—
কারা এতে ইন্ধন দিচ্ছে, কারা ভাঙচুর ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ভিডিও ফুটেজ দেখে তাদের শনাক্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে। একই সঙ্গে শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান রাখছি, তারা যেন কাজে ফিরে যায়। মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি সরকারের ওপর ছেড়ে দেন। শেখ হাসিনা সরকারই শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়ন করেছে। তিন দফায় সাত হাজার টাকা মজুরি বাড়িয়েছে। এখন নতুন করে আপনাদের প্রত্যাশা অনুযায়ীই বাড়ানো হবে। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে অযথা কেউ যেন ধৈর্য না হারায়। নিজেদের রুটি-রুজির জায়গাটি নষ্ট না করে।’বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের প্রধান ও অতিরিক্ত আইজিপি মো. মাহাবুবর রহমান কালবেলাকে জানান, ‘হঠাৎ করেই শ্রমিক আন্দোলনটি সহিংস হয়ে ওঠার পেছনে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন থাকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। আমরা আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এর ভেতরগত গভীরতা জানার চেষ্টা করছি। সার্বিক বিষয়ে আমরা কাজ করছি, যা সময় হলেই জানাতে পারব।’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবিটি বর্তমান সময়ের বিবেচনায় শতভাগ যৌক্তিক। এ বিষয়ে মালিক-শ্রমিক আর সরকার পক্ষ মিলেই পারে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান দিতে।’শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক ইন্ধনের অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে সব দেশেই শ্রমিক আন্দোলন বাড়ে। এতে শ্রমিক আন্দোলন যেমন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে একটা বাড়তি চাপ প্রয়োগ করতে পারে, একইভাবে তৃতীয় পক্ষগুলোও এ সময়ে শ্রমিকদের ব্যবহার করে বা তাদের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে বাড়তি ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করে। আসলেই ঘটনা কী সেটি সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে। তবে সবাইকে মনে রাখতে হবে, তৈরি পোশাক খাত দেশের অর্থনীতির অন্যতম একটা মেরুদণ্ড। এটা যাতে কোনো পক্ষের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে ব্যাকফুটে না যায়। এতে শ্রমিক-মালিক-সরকার তথা অর্থনীতি কারও জন্যই মঙ্গল হবে না।’
মজুরি বোর্ডে শ্রমিক প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি কালবেলাকে বলেন, ‘কোনো শ্রমিকই তার কর্মস্থল ভাঙচুর করতে পারে না। এর পরও আন্দোলনের নামে কোথাও কোথাও ভাঙচুর হচ্ছে। কারা এ ভাঙচুর করছে সেটি বের করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে এখন তৃতীয় পক্ষের ইন্ধন একসঙ্গে যোগ হয়ে গেছে।’তবে শ্রমিকদের চলমান আন্দোলনে রাজনৈতিক ইন্ধনের অভিযোগ নাকচ করে গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার কালবেলাকে বলেন, ‘গার্মেন্ট শ্রমিকদের যে আন্দোলন, সেটি মালিকপক্ষ থেকে অপরিপক্ব মজুরি প্রস্তাবের কারণেই তৈরি হয়েছে। আবার মজুরি বোর্ড এবং সরকারও এর দায় এড়াতে পারে না। তারা যদি ন্যূনতম মজুরির ঘোষণাটি ৬ মাসের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে পারত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি দেখতে হতো না।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই শ্রমিক নেত্রী বলেন, ‘সরকার-মালিক কিংবা অন্য কোনো পক্ষ যদি মনে করে, শ্রমিকরা কারও ইন্ধনে আন্দোলন করছে সেটি হবে ভুল ধারণা। কারণ শ্রমিকরা এখন পেটের তাগিদে আন্দোলনে নেমেছে। উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেলে তারা কেউই রাস্তায় থাকবে না। সরকার যত দ্রুত ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করবে, আন্দোলনও তত দ্রুতই মিলিয়ে যাবে বলেও দাবি করেন তিনি।’বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির কেন্দ্রীয় সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার বলেন, ‘শ্রমিকরা ক্ষমতার মসনদে বসার জন্য আন্দোলন করছে না, বরং তারা যেন তিনবেলা ঠিকমতো খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারে, ভালোভাবে কাজ করতে পারে সেজন্যই আন্দোলন করছে। শ্রমিকদের ২৩ হাজার ৩০০ টাকা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মালিকপক্ষ যখন ১০ হাজার ৪০০ টাকা মজুরির প্রস্তাব দিল,
তখন শ্রমিকদের ভীষণভাবে আতঙ্কিত করেছে। আর এই আতঙ্ক থেকেই তারা আন্দোলন শুরু করেছে। কারণ মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় মালিকপক্ষের প্রস্তাবিত মজুরি বাড়ানো নয় বরং কমানো হয়। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবনধারণ করাই কঠিন হয়ে পড়েছে, যে কারণে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে যদি দ্রুতসময়ে মজুরি ঘোষণা করা হতো তাহলে শ্রমিকরা এমন বিক্ষুব্ধ হতো না।’দেশের তৈরি পোশাকশিল্প দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই শিল্পের যারা অন্যতম কারিগর, তারাও ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের মালিকরা শিল্পটাকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন শ্রমিকদের ততটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না। এমনকি পোশাকের চেয়েও সস্তা মনে করেন শ্রমিকের জীবনকে। ফলে মালিকরা শ্রমিকদের এই যৌক্তিক বিক্ষোভকে ক্ষমতার মসনদে বসার কৌশল বলে মনে করছেন।’