দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ঘিরে ‘অবিবেচনাপ্রসূত’ মন্তব্য অব্যাহত রেখেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বে থাকা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থেকে নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কে তার নেতিবাচক বক্তব্য রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
আগামী ১ নভেম্বর থেকে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হচ্ছে। বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের সিদ্ধান্তে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলটি। অন্যদিকে দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রাজপথে আন্দোলন করছে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা। বড় দুই দলের বিপরীতমুখী এ অবস্থান নির্বাচন কমিশনের জন্যও অস্বস্তিকর। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে ইসি একটা সংকটে পড়ে গেছে। কারণ, একটি বড় দল বলছে, তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। আরেকটি দল বলছে, নির্বাচন হবে।’
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তৈরি হওয়া এ কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যেই সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের একের পর এক মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে।
দায়িত্ব গ্রহণের প্রথমদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের একপর্যায়ে সিইসি বলেছিলেন, ‘কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে।’
স্বাভাবিকভাবেই তার এই মন্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে বিরূপ সমালোচনার ঢেউ তোলে। রাজনীতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অভিমত ব্যক্ত করেন, একটি সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিত থেকে তিনি এমন কথা বলতে পারেন না। সমালোচনার মুখে অবশ্য তিনি সেই মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন এই বলে যে, কথাটি কৌতুক করে বলেছিলেন তিনি। আর গণমাধ্যম তার বক্তব্যকে ঠিকভাবে উপস্থাপন করেনি দাবি করে শেষমেশ ওই বক্তব্যের জন্য আবার ক্ষমাও চান তিনি।
ওই বক্তব্যের এক দিন পরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের দ্বিতীয় দিনে সিইসি আবার বলেন, ‘রাজনীতি, নির্বাচন ব্যবস্থাসহ সবকিছুই পচে গেছে।’ তার এমন বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।
এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এক বক্তৃতায় রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটের মাঠ ছেড়ে না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ‘আমি বলতে চাচ্ছি, মাঠ ছেড়ে চলে আসলে হবে না। মাঠে থাকবেন, কষ্ট হবে। এখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হয়তো দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারতেন; কিন্তু উনি পালাননি। তিনি রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরোধযুদ্ধ করে যাচ্ছেন। নির্বাচনের ক্ষেত্রও একটি যুদ্ধ, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। যেখানেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়, সেখানে কিছুটা ধস্তাধস্তি হয়। একজনের শক্তি দেখে চলে গেলে হবে না। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। নেতাকর্মীদের কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকতে হবে। তারা যদি ভোটকেন্দ্রে না থাকে, তাহলে অন্যপক্ষ অবাধে ভোট দিতে থাকবে।’
সিইসির ওই বক্তব্য দেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। তখন সিইসির ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে মৌখিক আলাপে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার ভি মানটিটস্কি সিইসির ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে বলেছিলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে জেলেনস্কির মতো মাঠে থাকার আহ্বান জানানোর মাধ্যমে সিইসি প্রকৃতপক্ষে রাশিয়াবিরোধী অবস্থান ব্যক্ত করছেন। ওই সময় রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়, ‘এ বক্তব্য সিইসির একান্ত ব্যক্তিগত, বাংলাদেশের অবস্থান নয়।’
গত জুনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র প্রার্থীর ওপর হামলা প্রসঙ্গে সিইসির মন্তব্য ছিল, ‘তিনি কী ইন্তেকাল করেছেন?’ এ নিয়ে চরম সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।
এ ছাড়া সিইসি তার বক্তৃতায় কোনো কোনো সময় বলছেন, ‘বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সেটি গ্রহণযোগ্য হবেনা।’ আবার কোনো কোনো সময় বলছেন, ‘কোনো দলকে নির্বাচনে আনা ইসির দায়িত্ব নয়। নির্বাচনে কে এলো না এলো তার চেয়ে বড় কথা জনগণ ভোট দিতে পারলো কি না।’ তার বিপরীতমুখী এমন বক্তব্যে বিভিন্ন সময় ভোটাররাও বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
সর্বশেষ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক থাকায় বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর তার চাপ পড়ছে বলে রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে ইটিআই ভবনে এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘আগের দুটি নির্বাচনের বিতর্কের চাপ আমাদের ওপর এসে পড়েছে। আমরা আগামীতে যে নির্বাচন করতে যাচ্ছি, সেটার বিশেষ দিক হচ্ছে, অভিযোগের মাত্রা অতিরিক্ত। নির্বাচন নিয়ে যে সংকট, সেটি হলো আস্থার সংকট। তাই আমাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। আমরা অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার চ্যালেঞ্জ নিতে চাই।’
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, সিইসি এমন সময় এ ধরনের মন্তব্য করেছেন, যখন আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনের দোহাই দিয়ে সরকারবিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনের উল্টো দিকে রয়েছে। ফলে সিইসির এ বক্তব্য তাদের দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘দায়িত্বের কারণেই কমিশনকে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিতে হয়। আর সাংবিধানিক দায়িত্বের কারণে তাদের বক্তব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য রাজনৈতিক দল ও ভোটারদের মধ্যে ক্ষোভ, বিভ্রান্তি ও আস্থাহীনতা তৈরি করে—এমন বক্তব্য কমিশনের কাছে কাম্য নয়। সেক্ষেত্রে যত কম কথা বলা যায়, ততই ভালো।’
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘নির্বাচনের সময় খুব একটা দেরি নেই। এখনো যদি নির্বাচন কমিশন ও কমিশনাররা অতিকথনে ব্যস্ত থাকেন, তবে তা নির্বাচনের জন্য সুখকর হবে না। সেজন্য বেফাঁস এবং অতিকথন বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনে কমিশনের মনোনিবেশ করা জরুরি।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল দায়িত্ব গ্রহণের আগ থেকেই চ্যালেঞ্জের মুখে আছেন। কারণ, তার নিয়োগ নিয়ে দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি শুরু থেকেই প্রশ্ন তুলেছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে সিইসি নিজেও বিতর্কিত সব মন্তব্য করে আলোচনায় থাকছেন। তার এ ধরনের অতিকথনের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেমন আস্থার বৃদ্ধি পায়, তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিভ্রান্তি তৈরি হয়। সেজন্য সিইসিকে অতিকথন বাদ দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘অনেক সময় কাজের চেয়ে অতিকথনে ব্যস্ত থাকেন সিইসিসহ নির্বাচন কমিশনাররা। তাদের নানা ধরনের বেফাঁস মন্তব্য রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভ্রান্তি ও আস্থার সংকট আরও বাড়িয়ে দেয়, যা মোটেও কাম্য হতে পারে না।
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় চাপের কারণে কমিশন একেক সময় একক ধরনের মন্তব্য করছে বলেও উল্লেখ করেন বদিউল আলম মজুমদার।