ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট

পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি নদী আর অসংখ্য খাল-বিলের জেলা মুন্সিগঞ্জ। দেশের প্রাচীনতম বিল আড়িয়লের অবস্থানও এই জেলায়। যে কারণে বর্ষার আগমনে জেলার বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠ, পথঘাট জলরাশিতে টইটম্বুর। এসময় যাতায়াত, মাছ শিকারসহ নানা কাজে প্রয়োজনীয় বাহন হয়ে ওঠে কোষা নৌকা। বিভিন্ন হাট-বাজারে কেনাবেচা হয় এ নৌকা।

এরমধ্যে জেলার সবচেয়ে বড় নৌকার হাটের দেখা মেলে শ্রীনগর উপজেলার বাড়ৈখালী ইউনিয়নের শিবরামপুরে ইছামতি নদীর তীরে। এ নৌকার হাট দুইশ বছরের পুরোনো। বর্ষায় ফের জমে উঠেছে হাট। সপ্তাহের প্রতি শনিবার কোষা নৌকার পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখর থাকে প্রাচীন এ হাট।

সরেজমিনে দেখা যায়, ইছামতি নদীর তীরের ওই স্থানটিতে বিভিন্ন আকারের কোষা নৌকা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে চলছে দরদাম। মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা ছাড়াও ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জ থেকেও এসেছেন ক্রেতারা। তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে একেকটি নৌকা। হাটবার ভোর থেকে শুরু হয়ে বিকেল ৩টা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা।

ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট
সংশ্লিষ্টরা জানান, শিবরামপুর হাটের গোড়াপত্তন কবে হয়েছিল তার সঠিক তথ্য কারও জানা নেই। সবাই বাপ-দাদার কাছ থেকে জেনেছেন ব্রিটিশ আমল থেকেই এখানে নৌকার হাট বসে। তবে আগে অনেক বেশি কদর থাকলেও ক্রমশ কমে আসছে নৌকা বেচাকেনা। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট তৈরির কারণে সড়কপথে বেড়েছে যোগাযোগ। এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে জলাশয় ভরাটের প্রতিযোগিতা চলছে। এসব কারণে অনেকাংশেই কদর কমেছে কাঠের তৈরি ছোট নৌযানটির। এরপরও পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই নৌকা নিয়ে হাটে আসেন বিক্রেতারা।

ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট

কয়েকজন বিক্রেতা ও কারিগরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নৌকা তৈরিতে সাধারণত কড়ই, মেহগনি আর চাম্বল কাঠ ব্যবহার করা হয়। এসব কাঠে মাটিয়া তেল, আলকাতরা, লোহার পেরেকসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে নৌকা তৈরি করা হয়। আট থেকে ১২ হাত দৈর্ঘ্য এবং দেড় থেকে দুই হাত প্রস্থের একেকটি নৌকা তৈরিতে কয়েকদিন সময় লাগে। তবে অভিজ্ঞ মিস্ত্রিরা এক থেকে দেড় দিনের মধ্যেই একটি নৌকা তৈরি করতে পারেন। বর্ষা এলেই নৌকা তৈরির ধুম পড়ে কারিগরদের। বর্ষার পানি যতদিন স্থায়ী হয় ততদিন নৌকা বেচাকেনা হয়।


জানা যায়, স্থানীয় খারসুর এলাকার জয়কৃষ্ণ, শিবরামপুরের প্রেমানন্দ, মন্টুসহ অনেক পরিবার বংশপরম্পরায় এ হাটে নৌকা বিক্রির সঙ্গে জড়িত। পণ্য পরিবহনসহ বর্ষায় এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হয় কোষা নৌকা। এছাড়া আড়িয়ল বিলসহ বিভিন্ন খাল-বিলে মাছ ধরা, শাপলা তোলা, গৃহপালিত প্রাণীর জন্য গো-খাদ্য আহরণে ব্যবহার হয় এসব নৌকা।

ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট

কোষা নৌকা বিক্রেতা আজিম মিয়া বলেন, শিবরামপুরের হাটটি কয়েকশ বছরের প্রাচীন। হাটের একটি ঐতিহ্য শনিবারের নৌকা হাট। প্রতি সপ্তাহে আশপাশসহ দূর-দূরান্ত থেকে নৌকা বিক্রেতারা হাটে আসেন। দিনব্যাপী চলে বেচাবিক্রি। পানি বেশি হলে নৌকা বিক্রিও বেড়ে যায়, লাভও ভালো হয়। এখন ভরা বর্ষা চলছে বেচাকেনাও বেশি হচ্ছে। একেকটি নৌকা বানাতে দুই থেকে চার হাজার টাকা খরচ হয়। সেগুলো তিন থেকে ছয় হাজার টাকায় বিক্রির টার্গেট থাকে।

ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট

ঢাকার নবাবগঞ্জ থেকে নৌকা নিয়ে হাটে আসা চাঁন শিবু মণ্ডল বলেন, আমার বাপ-দাদা এ হাটে নৌকা বিক্রি করেছে। আমরাও এ হাটে নৌকা বিক্রি করতে আইছি। তবে এখন কাঠের মূল্যবৃদ্ধিতে নৌকা বানানোর খরচ বেড়েছে। এছাড়া আগে লোক কম আছিল। এখন লোক বেশি। যে নৌকা বানাইতে খরচ হয় ২৫০০ টাকা, ক্রেতারা দাম বলে ১৫০০-২০০০ হাজার টাকা।
ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট

একই কথা বলেন আরও কয়েকজন বিক্রেতা। তাদের দাবি, হাটের ঐতিহ্য থাকলেও ভাটা পড়েছে ব্যবসায়। নেই আগের মতো লাভ। অনেকে বাপদাদার পেশা ধরে রাখতেই হাটে নৌকা বিক্রি করছেন। বিকল্প পেশায়ও চলে যাচ্ছেন অনেকে।

স্থানীয় বাড়ৈখালী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. রাজিব শেখ বলেন, শতশত বছর ধরে এই হাট চলছে। স্থানীয় অনেক মিস্ত্রিই বংশ পরম্পরায় নৌকা তৈরি ও বিক্রি করে জীবিকানির্বাহ করেন। পাকিস্তান ও বিট্রিশ আমলে এই হাট আরও জমজমাট ছিল। তখন রাস্তাঘাট কম ছিল, নৌকার চাহিদা বেশি ছিল। এখন আড়িয়ল বিলের বিভিন্ন স্থানে মাটি ভরাট করা হচ্ছে। প্রবেশ মুখগুলো বন্ধের কারণে বিলে পানি বেশি হয় না। এরপরও যতদিন কোষা নৌকার কদর থাকবে, ততদিন এই হাট বসবে।

ইছামতীর তীরে ২০০ বছরের পুরোনো নৌকার হাট

শিবরামপুর হাটের ইজারাদারের প্রতিনিধি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে প্রতি হাটে এক-দেড়শ নৌকা ওঠে। এরমধ্যে ৬০-৭০টি বিক্রি হয়। আগে চারদিকে পানি বেশি হতো তখন নৌকার কেনাবেচাও বেশি হতো। ১০-১৫ বছর আগেও প্রতি হাটে দেড়-দুইশ নৌকা বিক্রি হতো, এখন পানি কম তাই বেচাবিক্রি কমেছে। এরপরও এই হাট টিকে আছে। হাটে তেমন কোনো সমস্যা নেই। তবে আগের মতো খাল-বিলে পানি হয় না এটাই সমস্যা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *