ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মুশফিকুর রহিম। তাঁর গল্প অনেকটা সিনেমার মতোই। দরিদ্র পরিবারে জন্ম। জন্মের ৪৩ দিন আগে মারা যান বাবা।
মা সেলাই মেশিন দিয়ে কাজ করে মুশফিক ও তাঁর বড় ভাইকে বড় করেন।
সেই মুশফিকের দুটি কিডনিই নষ্ট হয়ে যায়। তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন বন্ধুরা। ৪২ দিনে ৩৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছেন তাঁরা।
সেই টাকা নিয়ে গত শুক্রবার ভারতে চিকিৎসার জন্য গেছেন মুশফিক। সঙ্গে আছেন মা ও বড় ভাই তফসির ইসলাম। এখন সেখানে মুশফিকের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ চলছে।
মুশফিকের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলার আড়াইসিধা গ্রামে।
প্রায় দুই মাস আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর দুটি কিডনি বিকল হওয়ার ব্যাপারটি ধরা পড়ে। প্রথম অবস্থায় প্রতি সপ্তাহে তাঁকে দুইবার ডায়ালিসিস করতে হয়। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় চিকিৎসক সপ্তাহে তিনবার ডায়ালিসিস করার পরামর্শ দেন। কিন্তু এই অল্প বয়সে ডায়ালিসিসই তাঁর পরিপূর্ণ চিকিৎসা হতে পারে না।
এ জন্য চিকিৎসক তাঁর পরিবারকে কিডনি প্রতিস্থাপন করার পরামর্শ দেন।
উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা প্রয়োজন বলে জানতে পারেন মুশফিক। পিতৃহীন মুশফিকের পরিবারের জন্য এই পাহাড়সম টাকার ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদদীন হলের ২০১৯-২০ সেশনের বন্ধুরা ৩৫ লাখ টাকা জোগাড় করে দেবেন বলে মুশফিকের পরিবারকে আশ্বস্ত করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৮ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অর্থ সংগ্রহের জন্য Fund For Musfiq পেজ ও গ্রুপ থেকে প্রচারণা চালানো হয়। এই প্রচারণার কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করতে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আর্থিক সাহায্য চেয়ে প্রচারণা চালানো হয়।
এ ছাড়া প্রথম সারির বিভিন্ন গণমাধ্যম মুশফিক ও তাঁর পরিবারের ভাষ্য নিয়ে প্রতিবেদন করে। প্রচারণার প্রথম দিন শেষে মুশফিকের বন্ধুরা প্রায় আড়াই লাখ টাকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। পরবর্তী ১৫ দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর আট লাখ টাকা সংগ্রহ হয়।
একটা পর্যায়ে অনলাইনে টাকা আসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, বিভিন্ন বিভাগ, মেয়েদের হল, ছেলেদের হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রুটের বাসের শিক্ষার্থীরা মুশফিকের চিকিত্সার জন্য অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। মুশফিকের হলের বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে ব্যানার লাগান এবং বক্স নিয়ে ক্রাউড ফান্ডিং করেন।
তহবিল সংগ্রহের একটা বিশাল অঙ্ক এসেছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি থেকে। তা ছাড়া সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, নরওয়ে ও কানাডা থেকে অর্থ সাহায্য এসেছে।
মুশফিকের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজসহ জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অর্থ সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসে। মুশফিকের নিজ উপজেলা আশুগঞ্জের বিভিন্ন শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সাহায্য এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি জসীমউদদীন হলের ২০১৯-২০ সেশনের বন্ধুরা মুশফিকুর রহিমের চিকিৎসার জন্য ৩৫ লাখ টাকা জোগাড় করে দেন। ছবি : সংগৃহীত
৩৫ লাখ টাকা সংগ্রহের এই প্রক্রিয়া সম্পর্কে মুশফিকের বন্ধুদের কাছে জানতে চাইলে তাঁরা জানান, তাঁরা অর্থ সংগ্রহ করার জন্য উসিলা হিসেবে কাজ করেছেন। মুশফিক কারো বন্ধু, কারো ছাত্র, কারো ভাই, কারো আত্মীয়, আবার কারো জন্য কেউই নন।
এর পরও অনেকে তাঁদের সাধ্যমতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মুশফিকের পাশে থেকেছেন, যা মানবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছে। এই সাহায্য পাঠানো ব্যক্তিরাই রিয়াল লাইফ হিরো।
বন্ধুদের সাহায্যে এমন অর্থ সংগ্রহ ও অর্থ প্রাপ্তির বিষয়ে মুশফিক, তাঁর বড় ভাই ও মা সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। দ্রুত সুস্থ হয়ে মুশফিক যেন আবার পড়াশোনায় ফিরে আসতে পারে এ জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তাঁরা।