খোঁজ নেই এমটিএফইর সিইও-অ্যাম্বাসাডরদের

দুবাইয়ে বসে পরিকল্পনা সাজিয়ে দেশ থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করেন এমটিএফইর মাসুদ আল ইসলাম। তার হয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিলেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) এবং দূত বা অ্যাম্বাসাডর পদধারীরা। সাধারণ মানুষকে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের এসব পদে বসানো হতো। তাদের কেন্দ্র করেই চলত ক্রিপ্টোকারেন্সিতে বিনিয়োগের নামে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) ব্যবসা। প্রতারণা ফাঁস হওয়ার পর ইতোমধ্যেই গা ঢাকা দিয়েছেন দেশে এবং বিদেশে অবস্থানরত এমটিএফইর সিইও-অ্যাম্বাসাডররা। তাদের কেউ কেউ আবার নিজেরাই প্রতারণার শিকার হয়েছেন বলে দাবি করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা হয়ে ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে প্রতারণার জাল বিস্তারে শতাধিক সিইও নিয়োগে দেন মাসুদ আল ইসলাম। ১০০ জন বিনিয়োগকারী বা দেড় কোটি টাকার বিনিয়োগ সংগ্রহ করতে পারলেই ‘সিইও’ পদের জন্য আবেদন করা যেত। আর ৩০ থেকে ৩৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে দেওয়া হতো ‘অ্যাম্বাসাডর’ পদবি। এসব পদধারীর মধ্যে আছেন অর্ধশতাধিক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা।

প্রতারণা স্পষ্ট হওয়ার পর এমটিএফইর সিইও এবং অ্যাম্বাসাডরদের নাম ও পরিচয় একে একে সামনে আসছে। অন্তত শতাধিক সিইও-অ্যাম্বাসাডরের একটি তালিকা এখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে রয়েছে। কালবেলার নিজস্ব অনুসন্ধানেও বেশ কয়েকজন সিইও-অ্যাম্বাসাডরের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। কাতারের দোহা থেকে সিইও হয়েছিলেন ঢাকার বনশ্রীর বাসিন্দা মনির হোসেন। গত ১৫ আগস্টও নতুন বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে দোহার একটি হোটেলে সেমিনার করেন তিনি।

মনির হোসেনের বাংলাদেশি মোবাইল নম্বরে রোববার দুপুরে কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এরপর থেকে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তার কাতারের নম্বরে হোয়াটসঅ্যাপে কল এবং লিখিত বার্তা দিলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কোনো সাড়া মেলেনি।

এমটিএফই বাংলাদেশ গ্রুপের সিইও হিসেবে পরিচয় দিতেন আব্দুল লতিফ নামের এক ব্যক্তি। বিলাসবহুল হোটেলে সভা-সেমিনার করে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতেন তিনি। সম্প্রতি তার আওতাধীন বিনিয়োগকারীদের নিয়ে একটি হোটেলে সিইও হওয়ার আনন্দ উদযাপন করেন লতিফ। তার বাংলাদেশি নম্বরে ফোন দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। আব্দুল লতিফের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে, দেশেই আত্মগোপনে আছেন তিনি।

এমটিএফই গ্রুপের কুষ্টিয়া অঞ্চলের সিইও এবিএম রফিক উদ্দিন কালবি। তার সিইও পদবিপ্রাপ্তি উদযাপন এবং নতুন বিনিয়োগকারী আকর্ষণের জন্য গত ২৩ জুলাই কুষ্টিয়ার একটি হোটেলে সেমিনার আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক মোস্তাফিজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘রফিক উদ্দিনের গ্রুপে আমিও বিনিয়োগ করেছিলাম। আমাদের বলা হতো ‘ট্রেডার’। আমার ৪ হাজার ডলার বিনিয়োগ ছিল। এখন অ্যাপে মাইনাস ৪ হাজার ৪০০ ডলার দেখাচ্ছে। মানে, আরও ৪০০ ডলার লোকসানে আছি। রফিক উদ্দিনের প্রায় ১০ হাজার ডলার বিনিয়োগ ছিল। তার মোবাইল বন্ধ পাচ্ছি। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

দুবাইয়ে ব্যবসা করেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা মুবাশ্যিরুল ইবাদ। এক সময় এমটিএফইর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। গত জুলাই মাসে ‘অ্যাম্বাসাডর’ পদও পান।

নিজেরাই এমটিএফইর প্রতারণার শিকার হয়েছেন দাবি করে মুবাশ্যিরুল ইবাদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা নিজেরাও মাসুদের প্রতারণায় পড়ে গেছি। সে খুব নিখুঁতভাবে এই কাজটি করেছে। শুধু আমি না, আমার মতো প্রচুর অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তাকে সে স্রেফ মানুষ পটানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আমাদের সামনে রেখে, আমাদের দেখিয়ে সে নিজে পেছনে থেকেছে। মাস দুয়েক আগে যখন সমস্যা শুরু হয়, টাকা উত্তোলন করা যাচ্ছিল না; তার আগ পর্যন্ত আমরাও প্রতারণার বিষয়টি বুঝিনি।’

ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন এবং অর্থ পাচারের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ, এটা আমি জানতাম না। এজন্যই আমি দুবাইয়ে চলে আসি ক্রিপ্টো নিয়ে কাজ করার জন্য। তবে অর্থ পাচারের সঙ্গে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত ছিলাম না। এটা মাসুদ জানে। আর আমি কাউকে প্রলোভন দিয়ে এমটিএফইতে আনিনি। কিন্তু এখন আমি এবং আমার মতো যারাই আছে, তাদের সবার অবস্থাই করুণ। আমরা আমাদের মানসম্মান খুইয়েছি। পরিবার পরিজন ছাড়া এখানে একাকী পড়ে আছি। দেশে থাকা প্রিয়জনদের ওপর দিয়ে যে ঝড় যাচ্ছে, সেটি চিন্তা করলেই খারাপ লাগে। আমাদের হয়তো কিছু লোভ ছিল, কিন্তু আসলে আমরাও ভুক্তভোগী।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *