নোবেল, ড. ইউনূস, সরকার, বাংলাদেশ বা বিশ্বনেতা; কারও ইজ্জত-ইমেজে আঘাতই অবশিষ্ট থাকল না। নোবেলপ্রাপ্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন পুরোদস্তুর আদালতের আইটেম, সরকারের প্রতিপক্ষ, বিদেশি হেভিওয়েটদের খাস দরদি।
সেইসঙ্গে নোংরা-কদাকার যত কথাবার্তারও শিকার। ডালপালা ছড়িয়ে এতে আরও নানা বিষয়-আসয় যোগ হয়ে পড়েছে। কথা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে তাকে ঘিরে। সেইসঙ্গে উদ্বেগও।
প্রশ্নের পর প্রশ্নের বিশাল প্রশ্নমালা তাকে ঘিরে। ড. ইউনূসকে নিয়ে অনেক কথা বললেও শেখ হাসিনার এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিকস সম্মেলনে তার অংশগ্রহণ ও সফর নিয়ে। ড. ইউনূস, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের অবিরাম চাপ মিলিয়ে কী হতে যাচ্ছে? দেশ কোনদিকে যাচ্ছে?—
নির্দিষ্ট এ দুই প্রশ্ন করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও। তার এক বাক্যের জবাব, সেটা জনগণ জানে তারা কী চায়? জবাবের মাঝেও প্রশ্ন। জনগণ কী চায়—এ প্রশ্নের জবাব জানতে হয় নির্বাচনের মাধমে। এ নিয়েই তো অন্তহীন গন্ডগোল।
নির্বাচনের ঢের আগ থেকেই ড. ইউনূসকে ঘাঁটতে গিয়ে আন্তর্জাতিক ইস্যু তৈরি হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত এর লাভ-ক্ষতির অঙ্কও প্রশ্নবিদ্ধ। তার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন মহলের উষ্মা-বিরক্তি ওপেন সিক্রেট। বিশ্বে ড. ইউনূস নোবেল লরিয়েট,
সোশ্যাল বিজনেস তত্ত্বের পুরোধাসহ আরও অনেক কিছু হলেও সরকার ও সরকারি দলের লোকদের কাছে তিনি স্রেফ একজন সুদের কারবারি। করখেলাপি, দেশবিরোধীও। তাকে নোবেল দেওয়া ঠিক হয়নি—এমন অভিযোগের সঙ্গে অর্থনীতির লোক শান্তিতে নোবেল পান কেন, এ প্রশ্ন করে যাচ্ছেন তারা।
এসব অভিযোগের সঙ্গে তাকে নিয়ে সমালোচনার ভাষা কখনো কখনো নিম্নমানের ভাষায় ঠাসা। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের হালনাগাদ অভিযোগ হচ্ছে, শেখ হাসিনাকে উৎখাতের দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলছে। বিএনপি নেতারা আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে ড. ইউনূসকে নিয়ে নতুন খেলায় মেতেছে।
তারা ওয়ান ইলেভেনের মতো ড. ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন সরকারের দুঃস্বপ্ন দেখছে। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, যে কোনোভাবে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে হবে, বাঁচাতে হবে। তাকে জেল খাটিয়ে ছাড়ার সরকারি আয়োজন ও তৎপরতা অনেকটা স্পষ্ট। ইউনূস প্রশ্নে সরকার নাছাড়বান্দা। শ্রমিকদের পাওনা টাকা পরিশোধ না করায় আরও ১৮টি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
এই ১৮টিসহ তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে অন্তত ১৬৮টি। সর্বশেষ ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন শ্রমিক বাদী হয়ে আলাদা আলাদা মামলাগুলো করেন। বিষয়টি উপলব্ধি করে ১০০ জনেরও বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে। এতে স্বাক্ষর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন,
পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব। চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের একজন, রেজাল্টস অ্যান্ড সিভিক কারেজের প্রতিষ্ঠাতা স্যাম ডেলি-হ্যারিস এক বিজ্ঞপ্তিতে চিঠিটি প্রকাশ করেছেন।
চিঠিতে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদও দেওয়া হয়েছে। এ নিয়েও তীব্র উষ্মা সরকারের। ড. ইউনূসের পক্ষে ১০০ নোবেল বিজয়ীর বিবৃতিকে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপ, বলে জানানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের আইনজীবী দিয়ে।
এর আগে, ৪০ জনের বিবৃতির সঙ্গে এবারেরটির কিছু তফাত লক্ষণীয়।
এতে শুধু ইউনূসকে রক্ষা নয়, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সরকারের বৈধতার ঘাটতির কথাও এসেছে। এমন ব্যাপক পরিসরে আগে আর কখনো তিনটি বিষয় একসঙ্গে আনা হয়নি। কান টানতে গিয়ে মাথা কাটার এ অবস্থা সরকারের জন্য বিরক্তিকর। অ্যালার্মিংও।
এসব মামলায় ড. ইউনূসকে আর হয়রানি না করতে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠির শুরুতে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা’ সম্বোধন করে বেশ কবার ‘আমরা’ উল্লেখ করে লেখা হয়েছে—‘আমরা নোবেল পুরস্কার বিজয়ী, নির্বাচিত কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও সুশীল সমাজের নেতার পাশাপাশি বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে লিখছি।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে আপনাদের জাতি যেভাবে প্রশংসনীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে, আমরা তার প্রশংসা করি। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি দেখেছি, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা বিশ্বাস করি যে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়া এবং নির্বাচনে প্রশাসন দেশের সব বড় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়াটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে বৈধতার অভাব ছিল।’
‘ড. ইউনূসকে টার্গেট করা হয়েছে’—মন্তব্য করে বলা হয়েছে, ‘এতে আমরা উদ্বিগ্ন। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস।’ এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ সরকারের জন্য বিষের মতো। তার ওপর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের ভূমিকা রাখার সুযোগসহ বাংলাদেশ থেকে ‘নিরপেক্ষ বিচারকদের’ একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগের পর্যালোচনা করার কথাও বলা হয়েছে। চিঠির সমাপ্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশাবাদে বলা হয়েছে, ‘আসছে দিনে একটি অবাধ,
সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন এবং সব ধরনের মানবাধিকারের প্রতি সম্মান নিশ্চিত করবেন। সামনের দিনগুলোতে কীভাবে এই বিষয়গুলোর সমাধান করা হয়, তা ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রাখার জন্য আমরা বিশ্বের লাখ লাখ উদ্বিগ্ন নাগরিকদের শিবিরে যোগ দেব।’ এসব ভাষা সরকারকে রীতিমতো ওয়ার্নিং। স্বাভাবিকভাবেই তা সরকারের জন্য বিব্রতকর।
এ ছাড়া চিঠিটিতে ড. ইউনূসের নানা প্রশংসা তো আছেই। চিঠির এক জায়গায় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা মামলা বা অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দিয়ে পর্যালোচনা করার প্রস্তাব রয়েছে। সরকারের জন্য এটি কঠিন ভাবা হলেও সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী তা লুফে নিয়েছেন।
শুধু প্রস্তাব সমর্থন নয়, চ্যালেঞ্জের মতো তিনি আহ্বানও জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণকে।
সরকারের বিরক্তির বিপরীতে বিএনপি ড. ইউনূস প্রশ্নে বেশ পুলকিত। ভেতরের খবর হচ্ছে, দলটি ক্ষমতার জন্য প্রস্তুত নয়। তারা একটি ট্রানজিট পিরিয়ড চায়।
মধ্যবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের বাইরে অন্য কাউকে ক্ষমতায় দেখতে আগ্রহী বিএনপি। দেশি-বিদেশি হিতাকাঙ্ক্ষীদের নির্দেশনাও তেমনই। প্রথমে বিএনপিকে মাঠে নামানো হয়েছিল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায়ের জন্য।
এখন সেখান থেকে অনেকটা সরে গেছে তারা। এ ছক বুঝে বিএনপির কর্মসূচির সমান্তরালভাবে আওয়ামী লীগ রাজপথে থেকে উপরন্তু বিএনপিকেই কোণঠাসা করে ফেলেছে।
এরপর পশ্চিমা দেশগুলোর একটি ফর্মুলা ছিল যে, নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া। আওয়ামী লীগ এ ব্যাপারে একমত হয়নি। বরং আওয়ামী লীগ পারলে নির্বাচন আরও এগিয়ে আনে।
সব মিলিয়ে ড. ইউনূস সরকারের কাছে একটা আস্ত আপদ। এ আপদটি বিপদে রূপ নেওয়ার আতঙ্ক কিছুতেই পিছু ছাড়ছে না সরকারকে। রাজনৈতিক ডামাডোলে দেশে শুধু ইউনূস নয়, অভিনন্দন বা শোক প্রকাশেও যে কারও রাজনৈতিক রং মুখ্য হয়ে গেছে। এখানে পীর-পুরোহিত-উকিল-পেশকার-কুলি-কেরানি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী মূল্যায়িত হন রাজনৈতিক রঙে। রাজনীতির রং এখানে আকর্ণ করে, বিকর্ষণও করে।
রং লাগাতে উৎসাহ দেয়, সুড়সুড়ি অনুভব হয়। এখানে নজরুল-রবীন্দ্রনাথও মূল্যায়িত হন রাজনৈতিক বিবেচনায়। উৎসব-আনন্দ-প্রার্থনা-ইতিহাস প্রথা সবই বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস তার চিন্তার কারণে সমাজের একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠীর অপ্রিয় ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন।
আবার তিনি সম্মানিত বলে তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আমলে নেওয়া যাবে না—এ ধারণাও ঠিক নয়। তার মতো একজন মানুষের বিরুদ্ধে শ্রমিক ঠকানোর অভিযোগ ওঠা, কর পরিশোধ না করার অভিযোগ স্বস্তিদায়ক নয়। একইভাবে স্বস্তিদায়ক নয় বাঙালিপনায় নিম্নমানের গালমন্দে তার পক্ষে বিবৃতি দেওয়া বিশ্ববরেণ্যদের ইজ্জত বিনাশ করা।
বিষয়টা যতটা সাদামাটা মনে হয়, ততটা সহজ নয়। কোনো দেশের বিচার প্রক্রিয়াকে থামান কিংবা বন্ধ করে দেন, এটা কেউ বলতে পারে না। তারা কেন, কীভাবে বলেছেন, বিষয়টা পরিষ্কার নয়। নোবেল পুরস্কার লাভ করলে সব ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে ইনডেমনিটি পাওয়া যায় না। ড. ইউনূসকে প্রোটেক্ট করতে হবে কেন? তিনি দেশের আইন পরিপন্থি,
কর ফাঁকির মতো অপরাধে অভিযুক্ত ও প্রমাণিত হলে তাকে কিছু বলা যাবে না? এমন অপরাধ পশ্চিমা কোনো দেশে হলে দায়মুক্তির কথা ভাবা যেত না। ইজ্জতের প্রশ্ন এখানে আরও অনেকেরই।
লেখক : ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন